চট্টগ্রাম মহানগরীর আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রথম স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো অসম্পূর্ণ। কাজের মাত্র ৬৫ শতাংশ শেষ হলেও বকেয়া বিল পরিশোধ না করা, নির্মাণ উপকরণের ঘাটতি এবং অতিরিক্ত কাজের অনুমোদন বিলম্বে প্রকল্পটি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তায়য়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের অধীনে কাজ করা সাতটি দেশীয় উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অর্থ না পেয়ে কাজ বন্ধ রেখেছে। এর মধ্যে বকেয়া বিল পরিশোধ না করেই নতুন উপঠিকাদার নিয়োগের চেষ্টা চলছে, যা প্রকল্পে নতুন সংকটের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা ও কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ লেনদেন, দায়িত্ব এবং দায় এড়ানো নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। চট্টগ্রাম ওয়াসা দাবি করছে, তাদের কাছে কোনো বিল বকেয়া নেই, অন্যদিকে তায়য়ং বলছে, চট্টগ্রাম ওয়াসা অর্থ না দেওয়ায় তারা উপঠিকাদারদের পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এই জাতীয় প্রকল্পটি এখন অনিশ্চয়তার মুখে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমাপ্তি নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত ৯ অক্টোবর ৭টি উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রধান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার তায়য়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মি. ডব্লিউ. এস. পার্কের কাছে এক যৌথ চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে প্রকল্প পরিচালক মি. জাং ও এক্সিকিউশন ম্যানেজার মি. আন সুং জু-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
চিঠিতে উপঠিকাদাররা উল্লেখ করেন, দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রাপ্য বিল পরিশোধ করা হয়নি। এর ফলে শ্রমিকদের বেতন, যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী ও উপকরণ বিক্রেতাদের অর্থ পরিশোধে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বেতন বকেয়া রয়েছে ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত। এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সাইট অপারেশন চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা অবিলম্বে এই সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন, অন্যথায় কাজের ধারাবাহিকতা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাসের এইচডিপিই পাইপ এবং ফিটিংস-এর তীব্র ঘাটতি চলছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই ঘাটতি সরাসরি পাইপলাইন স্থাপনের কাজকে প্রভাবিত করছে এবং প্রকল্পের মাইলফলক অর্জনে বিলম্ব ঘটাতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে সমস্ত সক্রিয় সাইটে পর্যাপ্ত মালামাল সরবরাহের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কিছু অতিরিক্ত কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে এসব কাজের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ও অর্থপ্রদান এখনো বাকি রয়েছে, যা উপঠিকাদারদের জন্য নতুন আর্থিক সংকট তৈরি করেছে। এসব অতিরিক্ত কাজের মধ্যে রয়েছে ইন-সিটু বা ইটের তৈরি ইন্সপেকশন পিট নির্মাণ, ইউপিভিসি টাইপ পিট স্থাপন, সিসিটিভি টেস্টিং কাজ, ম্যানহোল রেইজিং ও স্থানান্তর কার্যক্রম, আরসিসি চেম্বার নির্মাণ, ডাবল কাভার স্ল্যাব স্থাপন, অ্যান্টি-থেফট ও অ্যান্টি-করোশন প্রটেকশন কাজ ইত্যাদি।
চিঠিতে বলা হয়, প্রকল্পের বাস্তব প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। তাই দ্রুত অনুমোদন ও বিল পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তায়য়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানানো হয়।
পত্রে সই করেন প্রকল্পের অধীনে কাজ করা মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, এস. এ ইঞ্জিনিয়ারিং, জাহান এন্টারপ্রাইজ, দেশ কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেড, ইনাস এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল ও পাওয়ারবাংলা কর্পোরেশন-এর প্রতিনিধি।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রথম প্রকল্পটির সাত বছর পার হলেও এখনো কাজের মাত্র ৬৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই দফা সময় বাড়ানো হলেও নতুন করে অর্থ সংকটে পড়ে প্রকল্পটি আবারো অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তায়য়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্য বিল পরিশোধ বন্ধ রেখেছে। ফলে সাতটি দেশীয় উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০ মে থেকে পাইপ বসানোর কাজ বন্ধ করে দেয়।
তায়য়ং দাবি করেছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই চট্টগ্রাম ওয়াসা তাদের অর্থ প্রদান বন্ধ রেখেছে, যা প্রকল্পের অগ্রগতিতে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। এদিকে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের দাবি অস্বীকার করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোরিয়ান এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো বিল বকেয়া নেই। মূলত নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতেই তারা এসব কথা বলছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরিয়ান এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে সম্প্রতি পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নিজ দেশে ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এসব কারণে উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসা জানায়, ঠিকাদারদের সঙ্গে ধাপে ধাপে চুক্তি করা আছে। তারা যতটুকু কাজ সম্পন্ন করেছে, ততটুকু বিল দেওয়া হয়েছে। ওয়াসার কাছে কোনো অর্থ পাওনা নেই। এ ছাড়া উপঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনার বিষয়েও চট্টগ্রাম ওয়াসার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কাজ বন্ধের ফলে যদি প্রকল্পে বিলম্ব হয়, তবে এর দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। সে ক্ষেত্রে ওয়াসা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
কেকে/ এমএস