আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে নানামুখী প্রস্তুতি ও কৌশলগত প্রচারণা। দলের প্রভাব বিস্তার ও ভোট বাড়াতে এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে ধর্মীয় স্থানেও। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন মসজিদে রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রভাব বিস্তার ও অবস্থান নেওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক বিভাজন ও সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি নোয়াখালী সদর উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের কাশেমবাজার জামে মসজিদে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইসলামী ছাত্রশিবির ও যুবদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত রোববার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে এ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৪০ জন আহত হন এবং মসজিদের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এ নিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনার প্রতিবাদে জেলা শহর মাইজদীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা।
এদিকে পাল্টাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। গতকাল সোমবার দুপুরে নোয়াখালী প্রেস ক্লাবে নেয়াজপুর ইউনিয়ন বিএনপির উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছেন।
এর আগে রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমীর জুমার খুতবা ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। গত ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে খতিবের বিরুদ্ধে জামায়াতবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ এনে একটি সতর্কতামূলক চিঠি পাঠানো হয়। তবে শুক্রবার জুমার নামাজের আগে খতিব প্রকাশ্যে সেই চিঠি মিম্বারে বসে ছিঁড়ে ফেলেন এবং বলেন, ‘রোজা আর পূজা এক নয়। সংযত হোন, সংশোধন হোন, তাওবা পড়ুন।’
এ সময় উপস্থিত মুসল্লি ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে খতিবের অবস্থানকে সমর্থন জানান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিঠিটি ছড়িয়ে পড়ার পর পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। জামায়াতের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বায়তুন নূর জামে মসজিদ এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ। তাই খতিবের দায়িত্ব হলো মিম্বার থেকে নিরপেক্ষভাবে কুরআন-হাদিসের আলোকে সবার জন্য হেদায়েতমূলক বক্তব্য রাখা। কিন্তু গত ১০ অক্টোবরের জুমার খুতবায় তিনি জামায়াত সম্পর্কে ‘বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বক্তব্য দিয়েছেন। এতে অনৈক্য, বিভেদ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, খতিব ব্যক্তিগতভাবে যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থক হতে পারেন, কিন্তু মসজিদের মিম্বারে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া অনুচিত। মসজিদে সব মত ও দলের মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন তাই পক্ষপাতমূলক বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চিঠিতে মসজিদ কমিটিকে আহ্বান জানানো হয় যেন সব মত ও দলের মুসল্লিরা নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করতে পারেন এবং পক্ষপাতমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। খতিবের বক্তব্যে অনড় অবস্থান এবং চিঠি প্রত্যাখ্যানের ঘটনায় উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ধর্মীয় স্থানকে ঘিরে এ ধরনের রাজনৈতিক মেরুকরণ সমাজে গভীর বিভাজনের ঝুঁকি তৈরি করছে। সাম্প্রতিক খুতবার অডিও-ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইমামরা কোথাও কোথাও সরাসরি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন এবং ভিন্নমতের মুসল্লিদের প্রতি পরোক্ষ হুমকি দিয়েছেন। এর ফলে নামাজ শেষে তর্ক-বিতর্ক ও উত্তেজনার ঘটনাও ঘটছে।
তারা বলছেন, মসজিদ মুসলমানদের একতার প্রতীক। এখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ ছড়িয়ে পড়লে তা সামাজিক সংহতি ও ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ মুসল্লিদের অনেকেই মনে করেন, মসজিদে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। মসজিদে সব দলের মানুষ নামাজ আদায় করেন; তাই এখানে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের জন্য সভা-সমাবেশ, প্রচার মঞ্চ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু মসজিদের মিম্বারকে রাজনীতির মঞ্চে পরিণত করা ধর্মীয় শালীনতার পরিপন্থি।
কেকে/ এমএস