বাংলার কৃষক সমাজের ইতিহাস মূলত এক দীর্ঘ শোষণ ও সংগ্রামের ইতিহাস। জমিদারি প্রথা, মহাজনি শোষণ ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি সব মিলিয়ে কৃষকরা যুগে যুগে পিষ্ট হয়েছে অন্যায়ের চক্রে। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাংলার মাটিতে বারবার জেগে উঠেছে প্রতিবাদের আগুন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬-৪৭ সালে উত্তরবঙ্গে যে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়, সেটিই ইতিহাসে ‘তেবাগা আন্দোলন’ নামে খ্যাত। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে আসেন এক সাহসী নারী ইলামিত্র (১৯২৫-২০০২), যিনি আজও বাংলার কৃষক ও নারী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে অম্লান।
ইলামিত্রের জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯২৫ সালে কলকাতায়। তার পিতা ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক নীরদচরণ সেন। মা ছিলেন স্নেহময়ী ও শিক্ষিত গৃহিণী। কলকাতার লরেটো কলেজে পড়াশোনা শেষে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। শিক্ষাজীবনে তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিক্ষা, সংগঠন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চায় সমান দক্ষ।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৯৪০ সালে, তিনি ভারতীয় মহিলা অ্যাথলেটিক দলের হয়ে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণের মনোনয়ন পান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই অলিম্পিক বাতিল হওয়ায় তিনি অংশ নিতে পারেননি। তবুও এ ঘটনাটি তার জীবনের এক গর্বের অধ্যায় হয়ে আছে যেখানে রাজনীতি, সংগ্রাম ও খেলাধুলা একাকার হয়ে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৭৯৩ সালের স্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলায় জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। এর ফলে কৃষকরা তাদের নিজস্ব জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং জমিদারের জমিতে ভাগচাষি (বর্গাচাষি) হিসেবে কাজ করতে থাকে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ জমিদার ও এক-তৃতীয়াংশ চাষি পেত। এ অন্যায্য ব্যবস্থাকে বলা হতো আধাভাগ বা দ্বিভাগ প্রথা।
কৃষকের পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের অধিকাংশ চলে যেত জমিদারের গুদামে; ফলে ঋণ, দারিদ্র্য ও মহাজনি শোষণ তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বাংলা প্রাদেশিক কৃষক সমিতি আন্দোলনের ডাক দেয়, যা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগঠন হিসেবে কাজ করত। কৃষক সমিতি স্লোগান তোলে ‘তেভাগা চাই’ অর্থাৎ, চাষির ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ চাষির ঘরে থাকবে, জমিদার পাবে এক ভাগ। এ দাবিই পরবর্তীকালে তেভাগা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
১৯৪৬ সালে দিনাজপুর, রংপুর ও জলপাইগুড়িতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন দ্রুত রাজশাহী ও বগুড়ার কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকরা তিনটি মূল দাবি তোল
১. ফসলের তেভাগা (তিন ভাগের দুই ভাগ) কৃষকের ঘরে রাখতে হবে।
২. ফসল ভাগের সময় জমিদারের গোলায় নয়, চাষির গোলায় মাপ নেওয়া হবে।
৩. মহাজনি শোষণ, অন্যায্য খাজনা ও সুদ বন্ধ করতে হবে।
এ আন্দোলনের নেতৃত্বে কৃষক সমিতির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নারীরাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নামে। হাতে বাঁশ, হাল, কাস্তে নিয়ে তারা জমিদারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সে সময়েই কৃষক-নারী সমাজে এক নতুন নাম প্রতিধ্বনিত হয় ইলামিত্র। কমিউনিস্ট নেতা রমেন্দ্রনাথ মিত্রকে বিয়ে করার পর ইলা সেন পরিচিত হন ইলামিত্র নামে। স্বামীর সঙ্গে তিনি জলপাইগুড়ি অঞ্চলে স্থায়ী হন এবং উত্তরবঙ্গের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন। জলপাইগুড়ির নাকুগাঁও, পাটখারিয়া ও ধানতলা অঞ্চলে ইলামিত্রের নেতৃত্বে তেবাগা আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। তার অনুপ্রেরণায় হাজারো কৃষক ও কৃষাণী নিজেদের গোলায় ফসল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, জমিদারের গুদামে নয়।
এ অবাধ্যতা দমন করতে ব্রিটিশ পুলিশ ও জমিদাররা হামলা চালায়। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ইলামিত্রকে গ্রেফতার করে। কারাগারে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তবু তিনি কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি, আন্দোলনের নামও মুছে দেননি নিজের হৃদয় থেকে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি পরে বলেন ‘তারা আমার শরীর ভেঙে দিতে পেরেছিল, কিন্তু আমার মনোবল ভাঙতে পারেনি।’ দীর্ঘ কারাবাসের পর মুক্তি পেয়ে ইলামিত্র আবারও মাঠে ফেরেন, নারীর অধিকার, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে কাজ করেন। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে বামপন্থি রাজনীতির মূলধারায় যুক্ত হন।
তেভাগা আন্দোলন তৎকালীন সময়েই দমন করা হয়, কিন্তু এর প্রভাব ছিল গভীর। সমাজে শ্রেণি-চেতনা, কৃষকের অধিকারবোধ এবং নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের যে জোয়ার তৈরি হয়, তা পরবর্তীকালের ভূমি সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলনের প্রভাবে প্রণীত হয় ‘বর্গাচাষি সুরক্ষা আইন’ যা ভাগচাষিদের অধিকার আইনগতভাবে নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী ভূমি সংস্কার ও কৃষক সংগঠনের নীতিতে তেভাগা আন্দোলনের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, তেভাগা আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে এক অনন্য শ্রেণিভিত্তিক কৃষক বিদ্রোহ। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার ও মর্যাদার আন্দোলন।
ইলামিত্র প্রমাণ করেছেন যে, সংগ্রাম শুধু পুরুষের নয় নারীও সমাজ পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হতে পারে। তীব্র নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি যে দৃঢ়তা ও সাহস দেখিয়েছেন, তা আজও অনুপ্রেরণার উৎস। তার নেতৃত্বে নারীরা বুঝতে শিখেছিল তারা শুধু ঘরের নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনেরও অংশীদার। ইলামিত্রের মৃত্যুর পরও (১৩ অক্টোবর ২০০২, কলকাতা) তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তার জন্মদিন ১৮ অক্টোবর আজও ‘তেবাগা দিবস’ হিসেবে অনেক স্থানে পালিত হয়।
তেভাগা আন্দোলন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পূর্ণ সফল না হলেও, এটি বাংলার কৃষক সমাজে এক মোড় ঘোরানো অধ্যায় সৃষ্টি করে। কৃষকের আত্মসম্মান, নারী নেতৃত্ব ও শ্রেণি-সংগ্রামের যে বীজ এ আন্দোলন বপন করেছিল, তা আজও প্রাসঙ্গিক। ইলামিত্রের জীবনী শেখায় ন্যায়বিচার ও মর্যাদার জন্য লড়াই কখনো বৃথা যায় না। চাষিরই ফসলের তেবাগা এ স্লোগান আজও বাংলার মাটিতে প্রতিধ্বনিত হয়, আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে তখনই, যখন শ্রমজীবী মানুষের ঘরে আলো পৌঁছায়।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
কেকে/ এমএস