মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শেভরনের পাইপলাইনে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে ফারজানা আক্তার পারভীন নামে আরও একজন মারা গেছেন। এর আগে আগুনে দগ্ধ হয়ে তার স্বামী বশির মিয়া এবং ছেলে রেজায়ান মিয়া চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
বুধবার (১ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারজানা। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি পুরো পরিবার অগ্নিকাণ্ডে ঝরে গেল।
এ তথ্য নিশ্চিত করে স্থানীয় ইউপি সদস্য সালেক মিয়া বলেন, দগ্ধ বাবা-ছেলের মৃত্যুর পর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় বুধবার সকালে অগ্নিদগ্ধ রেজোয়ানের মা পারভীনও মারা যান।
কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
জানা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার ২নং ভুনবীর ইউনিয়নের শাসন ইলাম পাড়ায় পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানি শেভরনের একটি পাইপলাইন ছিদ্র করে তেল চুরি করছিল দুর্বৃত্তরা। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে পাইপলাইন ছিদ্র করে তেল চুরির সময় তেল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং হঠাৎ আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে তার আগেই আগুনে দগ্ধ হন ওই পরিবারের তিনজন সদস্য। দগ্ধ অবস্থায় প্রথমে তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরদিন ঢাকায় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার দিনের ব্যবধানে মারা যান বাবা ও ছেলে। এরপর আরও চার দিন পর মৃত্যু হয় ফারজানা আক্তারের।
তেল চুরি সিন্ডিকেটের অভিযোগ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শেভরনের এক কর্মচারী জানান, দুর্বৃত্তরা ১২ ইঞ্চি পাইপ ছিদ্র করে তেল বের করার চেষ্টা করে। পরে পাইপের সেই ছিদ্র আর বন্ধ হচ্ছিল না। এ লাইনে অনেক প্রেসার থাকে। পরে ছিদ্রকারীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
অন্য একটি সূত্র জানায়, এই তেল চুরির সঙ্গে শেভরন কোম্পানির পাহারাদাররা জড়িত রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে পুরোনো একটি তেল চুরির সিন্ডিকেট কয়েক মাস ধরে তেল চুরি করে যাচ্ছে। এই তেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় বিক্রি করা হয় বলে জানা গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিযোগ
নিহতদের পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় শেভরন কোম্পানি নিহতদের চিকিৎসা খরচ বাবত গতকাল পর্যন্ত ৭০হাজার এবং প্রশাসন থেকে মোট ৪০হাজার টাকা তারা পেয়েছে। এর বাইরে ক্ষতিপূরণ বা আর্থিক কোনো সহযোগিতা তারা পায়নি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার।
শেভরনের প্রতিক্রিয়া
শেভরন বাংলাদেশের মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক শেখ জাহিদুর রহমান বলেন, দুর্বৃত্তরা পাইপলাইনে ছিদ্র করে তেল চুরির চেষ্টা চালায়। ফলে তেল ছড়িয়ে পড়ে ছড়ার পানিতে মিশে যায় এবং পরে পানির ওপর ভাসমান তেল থেকে আগুন ধরে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শেভরন কোম্পানি ‘দুর্বৃত্তরা তেল চুরির উদ্দেশ্যে পাইপলাইনে ছিদ্র করেছে’ মর্মে বিবৃতি প্রদান, শোক প্রকাশ এবং শ্রীমঙ্গল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি এবং একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
প্রশাসনের বক্তব্য
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন দৈনিক খোলা কাগজকে জানান, শেভরনের পাইপলাইনে অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের ৩জনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে প্রশাসন। এ ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, পেট্টোবাংলা এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ। তবে নিহত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত নগদ ২০ হাজার এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরো ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অসহায় পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে বলে ইউএনও নিশ্চিত করেন।
কেকে/ আরআই