প্লাস্টিক, স্টিল, কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি কলমের কথা আমরা জানি। কাগজ দিয়ে তৈরি কলমও দেখেছি। কিন্তু ওই কাগজের কলম ব্যবহারের পর ফেলে দিলে তা মাটির সঙ্গে মিশে সবুজ চারা জন্মায়। সফলভাবে এ রকম বিস্ময়কর কাজ করে চলেছেন যশোর শহরের লোন অফিসপাড়ার বাসিন্দা নাছিমা আক্তার ও তার উচ্চশিক্ষিত মেয়ে রেবেকা সুলতানা।
জানা যায়, পরিবেশবান্ধব কাগজ দিয়ে তৈরি কলমের সঙ্গে বীজ সংযুক্ত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন তারা। সেই বীজ থেকেই জন্মাচ্ছে গাছের সবুজ চারা। মা-মেয়ের এমন উদ্যোগ দেখে এখন এলাকার অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বলে জানান। ‘বীজযুক্ত কলম’ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে নাছিমা আক্তারের পরিবার।
প্লাস্টিকমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে গত জানুয়ারি থেকে এই কলম বাজারজাত করছে তারা। কলমের কালি শেষ হওয়ার পর তা সবাই ফেলে দেন। তখন কাগজের কলমটি মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এর কিছুদিন পরেই চারার অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। ‘আমি করোনার পরে পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করি। সুপারিপাতার প্লেট, বাঁশের তৈরি টুথব্রাশসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অনলাইনে বিক্রি করছি।
ফেসবুকে কাগজের তৈরি পরিবেশবান্ধব কলমের বিজ্ঞাপন দেখে নাছিমা আপার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে দেখে স্বল্প পরিসরে বাড়িতে বসে আমি আর আমার মেয়ে এই কলম তৈরি করতে শুরু করি।’ এর আগে ‘পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম’ উদ্ভাবন ও বাজারজাত করেন নাছিমা আক্তার। বর্তমানে তারা যুগপৎ পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম ও কাগজ দিয়ে বীজযুক্ত কলম তৈরি করছেন।
এরই মধ্যে তাদের উদ্ভাবিত কলম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নমুনা হিসেবে বিদেশের মাটি ছুঁয়েছে। খুচরা পর্যায়ে নাছিমা-রেবেকার তৈরি বীজযুক্ত কাগজের কলম ১৫ টাকা এবং শুধু কাগজের কলম ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ১০০টির বেশি কলম কিনলে অর্থাৎ পাইকারিতে সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৭ টাকা দরে কলম বিক্রি করেন তারা। এ কলমের বড় অংশের ক্রেতা হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। কলমে এসব সংস্থার নাম ও ঠিকানা ছাপিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে সাতজন কারিগর মিলে গড়ে দিনে এক হাজার কলম তৈরি করেন।
নাছিমা আক্তার বলেন, যৌথ পরিবার ছিল। সংসারে অনেক সদস্য। আমার স্বামী সংসারের বড় ছেলে। তিনি বিজিবিতে সিগন্যালম্যান পদে চাকরি করতেন। কানে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ২০০০ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। অবসরের সময় যে টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে মাছের খামার করেন। কিন্তু লোকসান হয়। নিঃস্ব হয়ে যাই আমরা। তখন সংসার চালাতে আমি কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। কিন্তু তাতে অল্প টাকা রোজগার হতো। সংসার চলত না।
পরে একটি কলমের সিসের সঙ্গে কাগজ জড়িয়ে দেখি, হাতে ধরে ভালোই লেখা যাচ্ছে। তখন ১০০টি কলম তৈরি করে স্কুলে নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করি। তিনি আরো বলেন, আমি বাড়িতে বসে কলম তৈরি করতাম, আর আমার ছেলে স্কুলে নিয়ে বিক্রি করত। ব্যবসার টাকায় মেয়েকে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া করিয়েছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) যশোরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, একমাত্র ছেলে মীর নাঈম আক্তার শুভর নামেই ‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ নামে তিনি একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মেয়ে রেবেকা সুলতানা ঢাকার একটি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সম্প্রতি মায়ের উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন। কলমের পেছনের অংশে বীজ সংযুক্ত করার পদ্ধতি মূলত রেবেকাই উদ্ভাবন করেন।
রেবেকা সুলতানা বলেন, মায়ের তৈরি কলম হাতে নিয়ে দেখলাম, এর পেছনে কিছুটা খালি জায়গা থাকে। যে জায়গাটা কেটে ফেলতে হয়। আমি চিন্তা করলাম, ওই জায়গাটা কীভাবে কাজে লাগানো যায়। তখন ভাবলাম, ব্যবহারের পর কলমটি তো সবাই ফেলে দেয়। কাগজের তৈরি কলম মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পেয়ারা, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, কাঁচা মরিচসহ দানাজাতীয় সবজি, ফুল ও ফলের ছোট ছোট বীজ কলমের পেছনের খালি অংশে সংযুক্ত করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখলাম। এতে ভাবনাটি সফল প্রমাণিত হয়। তাই কলমে বীজ সংযুক্ত করা হচ্ছে।
সম্প্রতি নাছিমা আক্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির বারান্দায় বসে সাত-আটজন কাগজের কলম তৈরি করছেন। কেউ কাগজ কাটছেন, কেউ আঠা লাগাচ্ছেন, আবার কেউ কলমের ক্যাপ তৈরি করছেন। এভাবেই তৈরি হচ্ছে কলম।
খুচরা পর্যায়ে নাছিমা-রেবেকার তৈরি বীজযুক্ত কাগজের কলম ১৫ টাকা এবং শুধু কাগজের কলম ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ১০০টির বেশি কলম কিনলে অর্থাৎ পাইকারিতে সাড়ে ৬ থেকে সাড়ে ৭ টাকা দরে কলম বিক্রি করেন তারা। এ কলমের বড় অংশের ক্রেতা হচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।
কলম বাজারজাতকরণের কাজটি করছেন নাছিমার ছেলে মীর নাঈম আক্তার। তিনি বলেন, দেশের ৬৪ জেলাতেই আমাদের কলম পাঠানো হচ্ছে। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় আমাদের কলম বেশি যাচ্ছে। এসব এনজিওর মধ্যে রয়েছে নারীপক্ষ, জাগো নারী উন্নয়ন সংস্থা, নারী মৈত্রী, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, সিসিডিবি, বন্ধু ফাউন্ডেশন ও বিআইজিডি উল্লেখযোগ্য।
রেবেকা সুলতানা বলেন, আমি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নেই। মায়ের ব্যবসা বড় করাই আমার লক্ষ্য। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পাট দিয়ে কলম তৈরি করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব এমন আরো পণ্য তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে, যেখানে অন্তত শত নারীর কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু পুঁজির অভাবে আমরা তা করতে পারছি না। সরকারি অনুদান পেলে এই উদ্যোগ আমরা এগিয়ে নিতে পারব।
কেকে/ এমএস