নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের সহিংস আক্রমণের শিকার হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমীরসহ কয়েকজন রাজনীতিবিদ। এ সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়ার ঘটনা ঘটে। প্রবাসী আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই জড়িত ছিলেন। এ সময় হেনস্তার শিকার জন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারাও।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থকরা তাসনিম জারাকে কটূক্তি বা অশ্লীল মন্তব্য করেন। মির্জা ফখরুলও এ অশোভন আচরণ থেকে নিরাপদে ছিলেন না। তারা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান।
এ ঘটনায় দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে নিয়ে হেনস্তার শিকার হওয়াকে সরকারের ব্যর্থতা মনে করছেন অনেকে। এ ব্যর্থতার জন্য কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে এনসিপি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে না দেওয়া বিদেশের মাটিতে এ ধরনের বিক্ষোভের বড় কারণ। তবে এ ধরনের বিক্ষোভ শুধু দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে না, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের প্রবেশও সংকুচিত হয়ে আসছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুল হাই গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এ ধরনের বিক্ষোভ করা অত্যন্ত অনুচিত। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশিদের সেসব দেশে প্রবেশ করতে দেওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ তৈরি করে।’ তিনি আরো বলেন, তিনি বলেন, ‘যারা এ ধরনের প্রতিবাদ করছেন তাদের বেশিরভাগই কিন্তু সেসব দেশের নাগরিক। তাদের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু সাধারণ বাংলাদেশিরা যখন এসব দেশে যেতে চাইবেন তাদের পথ সংকুচিত হয়ে আসবে।’
এদিকে এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ছেন মির্জা ফখরুল। তিনি এ ঘটনার পর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি পোস্টে লিখেছেন, ‘নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে যা ঘটেছে, তা আবারও প্রমাণ করল, আওয়ামী লীগ তাদের অন্যায়ের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করে না।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ আজ পর্যন্ত যা করেছে, সবকিছুর বিচার আইনের মাধ্যমে হবে। দল ও দেশের স্বার্থে ধৈর্য ধরুন।’
এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আখতার হোসেন বলেছেন, ‘আমরা সেই প্রজন্ম, যারা হাসিনার গুলির সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই নাই। অতএব, কারো ছোড়া ডিমে আমাদের কিছু যায়-আসে না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আওয়ামী লীগ জন্মগতভাবে ও প্রকৃতিগতভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা সন্ত্রাস করবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এয়ারপোর্টে আজকে আওয়ামী লীগ হুংকার দিয়ে আসছিল, অশ্রাব্য গালিগালাজ করছিল, বিশেষ করে তাসনিম জারাকে (এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক) উদ্দেশ্য করে। এটাই আওয়ামী লীগের চরিত্র।’
এ ঘটনায় এনসিপি ডায়াসপোরা অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে বলেছে, এ ঘটনা শুধু রাজনৈতিক সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মর্যাদা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার উদাহরণ। যদি সরকারি সফরের অংশগ্রহণকারীরা ন্যূনতম নিরাপত্তা না পান, তবে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাসগুলোর অস্তিত্বের যৌক্তিকতা কোথায় সে প্রশ্ন তোলে এ অ্যালায়েন্স। বাংলাদেশি কনস্যুলেট ও দূতাবাস কাদের স্বার্থে কাজ করছে এবং এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তোলা হয়।
সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় সফররত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে এনসিপির বিবৃতিতে তিনটি দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার এবং নিউইয়র্ক শহরের সরকারি কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে হবে। নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলসহ পুরো টিমকে অবিলম্বে চাকরিচ্যুত করতে হবে এবং সফররত নেতাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল এক যৌথ বিবৃতিতে আখতার হোসেনকে ডিম ছোড়ার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
কী ঘটেছিল নিউইয়র্কে :
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমানকে ডিম ছুড়তে দেখা গেছে। বিমানবন্দরের চার নম্বর টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় স্থানীয় সময় ২২ সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
আখতার হোসেনের সঙ্গে হাঁটছিলেন সফরসঙ্গী হিসেবে আসা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এ সময় তাসনিম জারাকে লক্ষ্য করে কটূক্তি করেন। তারা সেখানে বিক্ষোভ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী বিমানবন্দরের কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, পরপর দুটি ডিম ছোড়া হয়। এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের পিঠে ডিমগুলো লাগে। তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে হেঁটে যান। সবাই গাড়িতে ওঠার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। তারা ‘জয় বাংলা’সহ অন্যান্য স্লোগান দেন। এ সময় নিউইয়র্ক পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গীরা ম্যানহাটানের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে আছেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সেখানে প্রতিবাদ করার অনুমতি নিয়ে রেখেছে। সে অনুযায়ী সন্ধ্যায় তারা সেখানে বিক্ষোভ করেন। রাস্তার দুই পাশে পরস্পরবিরোধী স্লোগান দেয় এনসিপি ও আওয়ামী লীগ। সেখানে এনসিপি নেতা আখতার হোসেন এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিচার দাবি করেন।
এদিকে আখতার হোসেনকে ডিম ছোড়ার ঘটনার পর যুবলীগ কর্মী মিজানুর রহমানকে আটক করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বিএনপির কর্মীকে ছুরি দিয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সুলাইমান হক জানান, বিএনপিসমর্থিত এক ব্যক্তি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, মিজানুর রহমান তাকে ছুরি দিয়ে মারতে এসেছেন। এরপর নিউইয়র্ক পুলিশ তাকে আটক করে।
বিক্ষোভ শেষে সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আনন্দ উদ্যাপন করছিলেন। ২২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে নয়টার দিকে জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ স্ট্রিট থেকে পুলিশ মিজানুরকে আটক করে। এনওয়াইপিডি সূত্র বলছে, আগামীকাল মিজানুর রহমানকে আদালতে পাঠানো হবে। আজ রাত তাকে হাজতে কাটাতে হবে।
ডাকসুর নিন্দা :
আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়ার ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) উদ্বেগ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। গতকাল ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ডাকসুর বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গীদের ওপর জুলাই গণহত্যা পরিচালনাকারী কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় ডাকসু গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এ ঘটনার ডাকসু তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
শাহবাগে এনসিপির বিক্ষোভ :
যুক্তরাষ্ট্র সফররত এনসিপি নেতাদের ওপর আওয়ামী লীগের হামলা এবং ডিম নিক্ষেপের ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন এনসিপি নেতাকর্মীরা। গতকাল বিকালে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সমানে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। এনসিপি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আয়োজনে এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেন। এসময় তারা অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে হওয়া সফর কর্মসূচিতে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন।
হামলার ঘটনায় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি তুলে এনসিপি নেতারা বলেন, ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ দেশে ও বিদেশে এমন ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে টার্গেট করে হামলা করা হচ্ছে৷ তাই দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার এখন সময়ের দাবি।
কেকে/ এমএস