লাগাতার উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কবলে হাঁসফাঁস করছে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ। বাজারের সব কিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে টিকে থাকাই যেন দিন দিন কঠিনতর হয়ে পড়ছে। একটি পণ্য কিনতে গিয়ে তালিকা থেকে আরেকটি পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে। এতে করে এক রকম বাধ্য হয়েই মৌলিক চাহিদায়ও কাঁচি চালাচ্ছেন অনেকে। পাত থেকে বাদ পড়ছে প্রয়োজনীয় অনেক খাবারও। বাজারদরে দফায় দফায় উল্লম্ফন ঘটলেও এসব মানুষের আয় একই রয়ে গেছে। মাছ-ডিম খাওয়া এখন প্রায় স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষের কাছে। মাস টানতে হচ্ছে ডাল, ভর্তা ও সবজি খেয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া সংসারে ‘পেট ভরে’ এমন খাবারই খেতে হচ্ছে। তাই অনেকটা অনিচ্ছাতেই খাবারের তালিকা থেকে দিন দিন ছাঁটাই হচ্ছে পুষ্টিকর খাবার। আগে মধ্যবিত্তদেরও খাবারের যে বৈচিত্র্য ছিল, এখন সেটা পারছে না। ফলে প্রতিদিন যে পুষ্টির দরকার সেগুলো কোনোভাবেই এফোর্ট করতে পারছে না নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষ। যার প্রভাব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। এ ছাড়া এর প্রভাব আমরা সামনে আরো দেখতে পাব; পুষ্টিহীনতা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাবে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে গড় মজুরি বেশি হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইতিবাচক থাকে। কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে ঢাকায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেতনে জীবন চালাতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে। এমন এক পরিবারের একজন রবিউল মিয়া। রাজধানীর কাজিপাড়া মাদবরের পুকুরপাড়ে ৪ জনের সংসার তার। তেজগাঁওয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালিয়ে মাসে ১৪ হাজার টাকা বেতন পান তিনি।
রবিউল মিয়া বলেন, যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই দায়। যে মাসে পরিবারের কেউ অসুস্থ হয় সে মাসে ধারদেনা করেই সংসার চালাতে হয়। এতে করে মাঝে-মধ্যে না খেয়েও থাকতে হয়।
তিনি আরো বলেন, এখন এমন খাবারই বেছে নিতে হচ্ছে, যাতে কেবল ‘বাঁচা যায়’।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির অবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দৈনিক একজনের স্বাস্থ্যকর খাবারের খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৬৪ ডলার অর্থাৎ ৪৪৩ টাকা ৫৭ পয়সা; যা কেনার সামর্থ্য নেই দেশের ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ বা ৮ কোটি ২৪ লাখ মানুষের।
প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া ও সন্তানের পড়াশোনার মতো অত্যাবশকীয় খরচের পর পরিবারের খাবারের সংস্থান করতে লড়াই করে করে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন রাজধানীর মালিবাগ এলাকার অটোরিকশাচালক রাকিব হোসেন।
কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি মাসে ১৫-১৭ হাজার টাকা ইনকাম করি। এর মধ্যে বেশিরভাগ টাকা চলে যায় বাসা ভারা দেওয়ায়। এরপর সন্তানের পড়াশোনাসহ অন্যান্য খরচের পর পকেটে থাকে না কোনো টাকা। যেখানে পেট ভরাই দায় সেখানে পুষ্টিকর খাবারের কথা চিন্তা করা অসম্ভব।
তিনি আরো বলেন, বাধ্য হয়েই খাওয়াও কমানো লাগতাছে। মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া এক রকম ছাইড়াই দিছি। সন্তানদের ফল কিংবা দুধ-ডিম খাওয়াইতে পারি না। মাছের মধ্যে পাঙাশ আর তেলাপিয়া খাই, যা দাম, তাও হিসাব কইরা খাইতে হয়। চালের খরচ কুলানো যাইতাছে না। তরিতরকারির দাম মেলা।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা অবনমনের তথ্য উঠে এসেছে কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের প্রতিবেদনে। অক্টোবরে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন ধাপ অবনমন হয়ে এবার ১২৭টি দেশের মধ্যে ৮৪তম অবস্থানে নেমেছে বাংলাদেশ।
আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টির শিকার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অপুষ্টির কারণে থমকে গেছে। এর মধ্যে ২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু তাদের পঞ্চম জন্মদিনে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীনের মতে, খাবারের উচ্চমূল্য, বৈশ্বিকভাবে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে খাবার কেনার সক্ষমতা কমেছে। এতে পুষ্টির ঘাটতি বাড়ছে, ফলে এ পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, যে খাবারগুলোর দাম বেশি, সেগুলো তারা কেনে না। যেগুলো কিনতে পারে, সেগুলো দিয়ে কোনো রকমে খায়। সবমিলিয়ে যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, তারা বর্ডারের কাছাকাছি চলে আসছে বা আরো লাইনের নিচে পড়ে গেছে।
কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টির সচেতনতা বাড়াতে কাজ করা সংগঠন বিআইআইডি ফাউন্ডেশনের মতে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার ফলে স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেছে। এভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হওয়ার সুযোগ নেই। এ পরিস্থিতির আরো বেশি অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
নিউট্রেশন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ প্রতিনিধির ভাষ্য, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ পুষ্টিকর খাবার কেনার সক্ষমতা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে পুষ্টিহীন লোকের সংখ্যা আরো বাড়বে।
দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি : জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২১-২৩ সালে মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বা ২ কোটি ৩ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এ সময়ে দেশে মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন ১১ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ আর মাঝারি বা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৫ কোটি ২৩ লাখ জনগোষ্ঠী।
তবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ২০ শতাংশ বা ১ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। আর ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সি ৩১ শতাংশ শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার।
ডব্লিউএফপির সর্বশেষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দাম বাড়ার কারণে ৩০ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে এবং ৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া ২৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ কমিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২৩ সালে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১৩০ টাকা।
পুষ্টিহীনতায় যেসব সমস্যা হচ্ছে : জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, পুষ্টিহীন শিশুদের বয়স অনুযায়ী উচ্চতা বাড়ে না, ওজন কম হয়, বড়দের ক্ষেত্রে পাতলা চুল, চুল পড়ে যাওয়া, রুক্ষ চেহারা, দেখতে অসুবিধা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দুর্বলতা, অসুখে বেশি আক্রান্ত হওয়া এবং সংক্রমণ বেশি হয়।
বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক প্রতিবেদন বলছে, অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সি ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থাৎ বয়সের অনুপাতে তাদের উচ্চতা বাড়ছে না। উপরন্তু পাঁচ বছরের কম বয়সি ১১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ উচ্চতার অনুপাতে তাদের ওজন বাড়ছে না।
পুষ্টিবিদরা মনে করেন, যেসব নারীরা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে তারা তো একটা সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিতে পারবে না। এসব বাচ্চাদের জন্মানোর পর বেশি পুষ্টি দিলে তারা ওভারওয়েট, স্থুল হবে। অসংক্রামক ব্যাধি- হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, ব্লাড প্রেশার বাড়ছে, ক্যানসার বেশি হচ্ছে; এগুলোর বড় কারণ ম্যালনিউট্রেশন। পুষ্টিহীন হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, শারীরিকভাবে কম শক্তিশালী হয়। পরবর্তী সময়ে যখন সে বড় হতে থাকে তার স্কিল বাড়ে না। রোগবালাই বেশি হবে, দ্রুত অসুস্থ হয়ে যাবে, কিডনির, হার্টের, ফুসফুসের সমস্যা হবে।
পুষ্টির ঘাটতি থাকলে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়; যার প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতে পরে। পুষ্টিহীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য যদি বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটা তাকে উৎপাদন সক্ষম রাখবে। অর্থাৎ এর জন্য ১০ টাকা বিনিয়োগ করা হলে ১২ টাকা হলেও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবে বলেও মনে করেন অর্থনীবিদরা।
কেকে/এআর