সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: শিক্ষা ভবনের সামনে ৭ কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ      হামাস-ইসরায়েল বন্দি বিনিময় শুরু, প্রথম দফায় ৭ জিম্মি হস্তান্তর      ভারী বর্ষণ-বন্যায় মেক্সিকোতে নিহত ৪৪, নিখোঁজ ২৭      ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      
খোলাকাগজ স্পেশাল
রাজবাড়ীতে মরদেহে অগ্নিসংযোগ
নেপথ্যে সংঘবদ্ধ চক্র
সিরাজুল ইসলাম, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী)
প্রকাশ: সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৯:৩২ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার দরবার শরিফে হামলা চালিয়ে কবর থেকে তার লাশ তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে পুড়িয়ে উল্লাস করে একদল মানুষ। গত শুক্রবার ৫ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের পর এ হামলা চালানো হয়। গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় হামলা-সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এ ছাড়া দরবারের ভক্তসহ শতাধিক মানুষ আহত হন। 

অভিযোগ উঠেছে, তৌহিদি জনতা এবং ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে এ হামলার ঘটনা ঘটলেও, তাণ্ডবে উসকানি দেয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তারা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বর্বরোচিত এ ঘটনা ঘটান। এতে স্থানীয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেমন জড়িত, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও জড়িত বলে তথ্যে জানা গেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। 

গ্রেফতাররা হলেন- দেওয়ানপাড়া গ্রামের আফজাল সরদারের ছেলে শাফিন সরদার (১৮), উজানচর ইউনিয়নের দিরাজতুল্লা মৃধাপাড়ার মৃত আক্কাস মৃধার ছেলে ও উজানচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধঘোষিত) সহসভাপতি মাসুদ মৃধা, বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের লাল মিয়া মৃধার ছেলে ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিরু মৃধা, দেওয়ানপাড়া গ্রামের মো. জহির উদ্দিনের ছেলে এনামুল হক জনি (৩২) ও কাজীপাড়া গ্রামের কাজি আরিফের ছেলে কাজী অপু (২৫)। গতকাল রোববার সকালে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক্রাইম অ্যান্ড অপস্ মো. শরীফ আল রাজীব।

জানা যায়, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগল বহু বছর আগে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন দরবার শরিফ। আশির দশকের শেষের দিকে নিজেকে ‘ইমাম মাহদী’ দাবি করে আলোচনায় আসেন তিনি। ওই সময়ে তার বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ তৈরি হয়। পরে জনরোষ এড়াতে তিনি মুচলেকা (অঙ্গীকার নামা) দিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি আবার ফিরে এসে তার দরবার শরীফের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন।

গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তিনি মারা যান। পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে বিশেষ কায়দায় দাফন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। গত মঙ্গলবার তারা সংবাদ সম্মেলন করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানায়। দাবি না মানলে জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইমান-আকিদা কমিটির গোয়ালন্দ উপজেলা আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দীন, সদস্য সচিব গোয়ালন্দ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আইয়ুব আলী খান, পৌর বিএনপির সভাপতি কাশেম মন্ডল, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমজাদ হোসেন এবং সাবেক বিএনপি নেতা খন্দকার আবদুল মহিত হীরা, উপজেলা মডেল মসজিদের ইমাম মাওলানা মুফতি আজম। 

জানা গেছে, ইমান-আকিদা কমিটি প্রথমে সাতদিন সময় বেঁধে দিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর স্নারকলিপি প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি সমাধানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে গোয়ালন্দ দরবার শরীফ এবং ইমান-আকিদা কমিটির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের হলরুমে আলোচনা হয়। সেখানে গোয়ালন্দ দরবার শরিফ অতিরিক্ত সাতদিন সময় চেয়ে নেয়। এরপর উপজেলা প্রশাসন এবং গোয়ালন্দ ঘাট থানার তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করে। প্রথমে তারা কবরের রং পরিবর্তন করে, এরপর ইমাম মাহাদীর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর চলে কবর খননের কাজ। এ সময় এই কাজে বারবার খোঁজ নেন প্রশাসন। সবশেষে শুক্রবারের আগেই কবর সমতলে নামিয়ে আনা হয়। ওইদিন সকালে গোয়ালন্দ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি জানিয়ে দেন দরবার কর্তৃপক্ষ। 

শুক্রবার বেলা বারোটার দিকে জেলা জামায়াত ইসলামের আমির এবিএম নুরুল ইসলাম বক্তব্য অনুযায়ী ইমান-আকিদা কমিটি ঘোষণা করে, তাদের দাবি পূরণ হয়েছে এবং তাদের বিজয় অর্জন হয়েছে। তাই আলোচনা সভার শেষে দোয়ার মাধ্যমে এখানেই কার্যক্রম শেষ করা হবে। এসময় বেলা তিনটার দিকে সমাবেশে একদল লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রবেশ করলে কমিটির পক্ষ থেকে সেগুলো পুলিশের কাছে জমা দিতে বলা হয়। এসময় গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশ সেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলে তারা পুলিশের ওপর হামলা করে। তখন পুলিশ দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে গেলে হামলা চালানো হয় পুলিশের গাড়িতে এবং ভেঙে ফেলা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি। 

একদল অপরিচিত লোক তখন দরবার শরিফে এসে হামলা চালায় তখন উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ঘটে, এক পর্যায়ে সভাস্থল থেকে লোকজন এসে একত্রিত হয়ে হামলা চালায়। এসময় হামলাকারীদের কাছে পরিচয় জানতে চাইলে কয়েকজন যশোর থেকে এসেছেন এবং দুজন সাতক্ষীরার কথা বলেন। পরে তাদের উসকানিতে স্থানীয়রাও জড়িয়ে পড়েন।

জুম্মার পর গোয়ালন্দ বাজার শহিদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয় তৌহিদি জনতা। দুপুর দুইটার পর থেকে আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন শত শত মানুষ। বেলা আড়াইটার দিকে একটি মিছিল হাতুরি, হামার, লাঠিসহ যোগ দেয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে লাঠি, হাতুরি মঞ্চে জমা দিতে বলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে মঞ্চে বক্তব্য চলাকালে কিছু উত্তেজিত মানুষ পুলিশের ওপর হামলা করে পুলিশের দুটি গাড়ি এবং ইউএনও’র গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

কিছুক্ষণ পর বেলা তিনটার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্য সচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান এবং মাওলানা আমিনুল ইসলাম কাশেমী সবাইকে বারণ করে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু কোনো বারণ না শুনেই উত্তেজিত জনতা মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলের দরবারে হামলা চালায়। পাল্টা আক্রমণ করেন নুরাল পাগলার ভক্তরা। ইট-পাটকেল নিক্ষেপসহ তুমুল সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হন। এ সময় কিছু মানুষ দরবারে দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মালামাল লুট করে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। বিকেল পাঁচটার দিকে নুরাল পাগলের মরদেহ কবর থেকে তুলে গোয়ালন্দ পদ্মার মোড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ের ওপর নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তৌহিদি জনতার ব্যানারে।

সেনাবাহিনীর আসার পর শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। এ সময় ভিতর থেকে রক্তাক্ত মানুষকে বের করে নিয়ে আসা হয়। অধিকাংশের শরীর রক্তে ভেজা ছিল। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে দেওয়া হয়নি গোয়ালন্দ দরবার শরিফের কাউকে। কথিত তৌহিদি জনতার ব্যানারে লোকজন ঘিরে রাখে হাসপাতাল। অনেকেই চলে যান রাজবাড়ী এবং ফরিদপুর হাসপাতালে। রাজবাড়ীতেও আক্রমণের শিকার হতে পারেন এমন আতঙ্কে অনেকেই বাড়িতে চিকিৎসা নিতে থাকেন। এসময় এরপর ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দিতে থাকেন ইমান-আকিদা কমিটিতে থাকা রাজবাড়ীর একজন সংবাদকর্মী। যিনি বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার প্ররোচনা দিতে থাকেন।  

এরপর বিকেল পাঁচটা থেকে পুলিশের উপস্থিতিতে চালানো হয় লুট। এতে স্থানীয়রাসহ বাইরের কিছু লোক অংশ নেয়। সারারাত ধরে চলে লুটপাট। বাড়ির চাল-ডাল, আসবাবপত্রসহ দামি জিনিসপত্র ট্রাকে করে নিয়ে যেতে থাকেন তারা। 

জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীব বলেন, ‘যেখানে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ কিছু উত্তেজিত জনতা পরিবেশকে অশান্ত করে তুলে, প্রথমে তারা পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর এরপর দরবার শরীফে হামলা ও লুটপাট করে। আমরা ইতোমধ্যেই গোয়ালন্দ ঘাট থানায় অজ্ঞাত ৩৫০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছি। ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হামলায় কারা অংশগ্রহণ করে : হামলায় শুধু স্থানীয় ইমাম কমিটি এবং তৌহিদি জনতা বা ইমান-আকিদা কমিটির লোকজন অংশগ্রহণ করে নাই। এতে অংশগ্রহণ করেছিল যশোর, সাতক্ষীরা এবং রাজশাহী থেকে আশা কিছু প্রশিক্ষিত লোকজন। তারা সব কিছু জানা শোনার পরও সভায় হাতুড়ি, রডসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। তারা লাশ পোড়ানোর আগে লাশের গালে লাথি মারছিল, পা দিয়ে পাড়া মারছিল। 

এরা একটি চক্র এদের পরবর্তী টার্গেট ছিল পরের দিন অর্থাৎ শনিবার হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর জন্মদিনে বড় জমায়েত হবে দৌলতদিয়া খানকা শরিফে সেখানে আক্রমণ চালানো। রাজবাড়ী জেলা পুলিশ পুলিশ মোতায়েন করে সেটা প্রতিরোধ করেছেন।

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

আটঘরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত
মানবিক পদক্ষেপে প্রশংসায় ভাসছেন ইউএনও লায়লা জান্নাতুল ফেরদৌস
অসুস্থ নাতনিকে দেখতে এসে লাশ হলেন নানা-নানি
কুশিয়ারা নদীতে শ্রমিকের লাশ উদ্ধার
বেনাপোলে কমছে আমদানি-রফতানি, বিকল্প রুটে ঝুঁকছে ব্যবসায়ীরা

সর্বাধিক পঠিত

নালিতাবাড়ীতে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত
বিশ্ব ব্যর্থতা দিবস আজ
আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস আজ
শীর্ষ মানবপাচার চক্রের মূল হোতা আটক
বাগেরহাটে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপন
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close