ভারতের সাতটি প্রদেশ-অরুণাচল, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড,আসাম এবং ত্রিপুরা জাতিগত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কারণে একত্রে সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত। আর এ সেভেন সিস্টার্সের অন্যতম প্রবেশদ্বার হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। ভারতের সঙ্গে কুটনৈতিক টানাপোড়েনে ভারতীয় ভিসা জটিলতায় আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের যাত্রীদের যাতায়াত উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যাত্রীদের ভ্রমনকর থেকে রাজস্ব আদায় দ্বিগুনেরও বেশি কমেছে। একই সময় নানা জটিলতায় আমদানি-রপ্তানির পরিমানও তুলনামূলকভাবে অনেক কমেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য আমদানি ১৫৮ টন ও রপ্তানি হয়েছে ৪৪ হাজার ৩২২ টন। যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৮ হাজার ৭৮৩ টন ও রপ্তানি ৫৪ হাজার ৪২২টন।
ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্টের ভাষ্য অনুযায়ী, কয়েকটি কারণে বন্দরে রপ্তানিসহ আমদানি ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। এর মধ্যে কিছু কারণ হলো ডলার সংকট, রাজনৈতি অস্থিতিশীলতা, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ভারত সরকার থেকে বাংলাদেশীদের ভিসা না দেওয়ায় যাতায়াত কমে যাওয়া।
ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট সূত্রে জানা গেছে, আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন পুলিশ চেকপোস্ট দিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬০ হাজার ৪৫২জন যাত্রী ভারতে ভ্রমন করেছে। এতে ভ্রমণকর থেকে সরকারের আয় হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ১ লাখ ৭০হাজার টাকা। একই সময় ভারত থেকে ৪০ হাজার ৫০৯জন যাত্রী বাংলাদেশে এসেছে।
কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৫৪জন যাত্রী আখাউড়া দিয়ে ভারতে গিয়েছে। এতে ভ্রমণকর থেকে সরকারের আয় হয়েছে ১৩ কোটি ৯১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ গত বছর বেশি যাত্রী ভারতে ভ্রমন করায় বাংলাদেশ সরকার এ বছরের তুলনায় গতবছর দ্বিগুনের বেশি রাজস্ব পেয়েছে। যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৩১ গুণ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে এসেছেন ৬৫ হাজার ৮৬৭জন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় ভ্রমন কর থেকে আয় অনেকটা কমেছে।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে স্থলবন্দর দিয়ে ৭ কোটি ৩১ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৯ টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। যা থেকে শুল্কস্টেশন ৪ কোটি ১৬ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৯ টাকার রাজস্ব পেয়েছে। এ সময়ে বন্দর দিয়ে মাত্র ১৫৮ দশমিক ৯১টন জিরা, ডাল ও কাজুবাদাম আমদানি হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্থলবন্দর দিয়ে ৭ কোটি ৫ হাজার ২০৩ দশমিক ৯ টাকার পণ্য আমাদানি হয়েছে। যা থেকে শুল্ক স্টেশন ৪ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৫৪৬ টাকার রাজস্ব পেয়েছে।
এ সময় বন্দর দিয়ে মূলত ৩৮ হাজার ৭৮৩ দশমিক ৫ টন পেয়াঁজ, আদা, জিরা ও পাথর আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বেশি টাকার পণ্য আমদানি হলেও পরিমাণ ও রাজস্ব আয় কমেছে অনেক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে ৫১৪ কোটি ৩৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। মোট রপ্তানি হয়েছে ৪৪ হাজার ৩২২ দশমিক ০৯ টন পণ্য। রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল সিমেন্ট, তাজা মাছ, শুটকি, পাথর, বর্জ্য তুলা, ম্যাংগো ফ্রুট ড্রিংকস, প্লাস্টিকের আসবাব, মেলামাইন সামগ্রী, পিভিসি পাইপ, পিভিসি দরজা, থ্রেসিং মেশিন, ডিফরমেট বার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪২৭কোটি ৮৮ লাখ ৭২ হাজার ৪৩০টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। মোট ৫৪ হাজার ৪৪২ দশমিক ২২ টন পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় কম। তবে গত মে মাসে ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে ছয় ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে নতুন অর্থবছরে রপ্তানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কা লাগবে বলেও মনে করছেন তারা।
স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা জানান, মে মাসে ভারত সরকার ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম ও মেঘালয়ের স্থলবন্দর গুলো দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফলের স্বাদযুক্ত জুস, তুলা, প্লাস্টিক, পিভিসি সামগ্রী ও কাঠের ফার্নিচার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও কাঠের ফার্নিচার ছাড়া বাকি সব পণ্যই নিয়মিত রপ্তানি হতো আখাউড়া বন্দর দিয়ে।
আখাউড়া স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি নেসার উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, নানা কারণে দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে রপ্তানি বাণিজ্য। আমরা নতুন পণ্যের বাজার খুঁজছি তবে নিষেধাজ্ঞায় থাকা পণ্য গুলোর চাহিদা ছিল বেশি। সরকার যেন দ্রুত ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে উদ্যোগ নেয় এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এ বিষয়ে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের সহকারী কমিশনার রীমা আক্তার বলেন, ব্যবসায়ীদের সবসময় রপ্তানি বাড়াতে উৎসাহিত করি এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করি। যেহেতু কিছু পণ্যে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই নতুন পণ্যের বাজার খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে সব পণ্যের আমদানির অনুমোদনের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এছাড়াও আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতগামী যাত্রীদের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু ভিসা জটিলতায় যাত্রী পারাপার কিছুটা কমেছে। রাজস্ব আদায়েও এর প্রভাব পড়েছে।
কেকে/ আরআই