চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শিক্ষক ও নিরাপত্তা কর্মীরাও রয়েছেন। এ ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার দাবি করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৭ জনসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ১৪৪ শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন আছে। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ বলেন, রাত ১২টার দিকে নিরাপত্তা টিম ঘটনাস্থলে গেলেও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে। তিনি আরো বলেন, যথাসময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত উপস্থিতি না থাকায় সংঘর্ষ বাড়তে থাকে।
এদিকে রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জোবরার এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করতে যায়। এ সময় উপ-উপাচার্য শামিম উদ্দিন ও অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, প্রক্টর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দারকে ধাওয়া দিয়ে আহত করা হয়। এ সময় আবার এলাকাবাসীর হাতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।
এ ছাড়া দুই শিক্ষার্থীকে ভবনের ছাদে কুপিয়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তাদের মধ্যে রাজিউর রহমান রাজু নামে দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অন্যজনের পরিচয় জানা যায়নি। স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেন, সামান্য ঘটনা থেকে এত বড় রক্তক্ষয়ী ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।
শিক্ষার্থী তাসনিম উদ্দিন জানান, ঘটনার পর থেকে পুলিশ প্রশাসনের কোনো সদস্য না থাকার কারণে শত শত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের চবি মেডিকেল সেন্টারে ভর্তির পর গুরুতরদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত গুরুতর বলে জানান চিকিৎসকরা। আহতদের সুরক্ষা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানান চবি মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডা. কামরুন নাহার।
স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান তৃণা জানান, ‘আমরা আহত শিক্ষার্থীদের সেবায় কাজ করছি। ফার্স্ট এইড নিয়ে কাজ করছি। মেডিকেলে আহতদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। বাইরে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে নিরাপদে আশ্রয় নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমরা আশা রাখি, সব কিছু দ্রুতই সমাধান হবে, ইনশাআল্লাহ।’
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : এর আগে শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজার এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দর্শন বিভাগের এক ছাত্রী ভাড়া বাসায় গেলে রাত ১১টার পর বাসায় ঢুকতে পারবে না বলে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় দারোয়ানের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও পরে মারধরের শিকার হন এ শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলে গেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয়রা মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এতে টানা চার ঘণ্টা ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করে। ওই ঘটনায় অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে অন্তত ১৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রক্টরের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ : রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাতের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই স্থানীয়রা আসিফ ভিলা নামক এক বাসায় অবস্থানরত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধারে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে আবারো সংঘর্ষ হয়। স্থানীয়রা দেশীয় অস্ত্র, ইটপাটকেল নিয়ে আক্রমণ চালায়।
প্রশাসনের সহায়তা না পেয়ে কাঁদলেন উপ-উপাচার্য : এদিকে আহতের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন। তার কান্না দেখে শিক্ষার্থীরাও কেঁদেছেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যায়, অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন বলছেন, ‘আমার ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি আহত। আমরা এখন পর্যন্ত আর্মি-বিজিবির কোনো সহায়তা পাচ্ছি না। ছাত্রদের তারা দা দিয়ে কোপাচ্ছে। এটা কোন জগতে আছি আমরা।
আপনারা আমাদের ছাত্রদের উদ্ধার করুন। আমাদের প্রক্টর, উপ-উপাচার্য আহত। আমাদের প্রায় সব শিক্ষক-ছাত্র আহত। আমরা মেডিকেলে জায়গা দিতে পারতেছি না। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে আমাদের ছাত্রদের মারতেছে। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দফতরে কথা বলেছি, কিন্তু এখনো আমাদের পাশে কেউ নেই।’
এ সময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা শান্ত হও, এলাকাবাসী আপনারা শান্ত হোন। আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বছর ধরে আছি, এই গ্রামের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। এটা অন্য একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধনে ঘটেছে। এ গেমে কেউ হাত দিও না।’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে উপ-উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা শান্ত হও। আমরা তোমাদের পাশে আছি। এ ঘটনার বিচার হবে।’
প্রশাসনের পদক্ষেপ : ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রোববারের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বহু শিক্ষার্থীকে চবি মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয় এবং গুরুতর অবস্থায় কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠানো হয়।
চবি মেডিকেলের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. টিপু সুলতান জানান, আমরা বহু আহত শিক্ষার্থীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি। গুরুতরদের চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমার জীবনে এমন ঘটনা কখনো দেখিনি।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা শাখাকে ফাঁকা গুলি করতেও দেখা গেছে। তবে, বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। বিকালে ৪টার দিকে যৌথবাহিনীর নেতৃত্বে অভিযান চালালে ক্যাম্পাসের পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়।
ক্রমাগত সহিংসতার কারণে রোববার দুপুরে প্রশাসন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিনের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজার থেকে রেলগেট পর্যন্ত এলাকায় রোববার দুপুর ২টা থেকে সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। এরপর বিকাল চারটার দিকে সেনাবাহিনী পুলিশ ও র্যাব ঘটনাস্থলে আসে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ভুয়া ভুয়া বলে ধ্বনি তোলে। যৌথবাহিনী সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে অভিযান চালায়।
এদিকে এলাকাবাসীকে উসকানির অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে দলটি। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। এর আগে সকালে তেভেগা খামার এলাকায় এলাকাবাসীর সঙ্গে সমাবেশ করে বিএনপি নেতা উদয় কুসুম বড়ুয়া।
রোববার সন্ধ্যা সাতটায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, উপ-উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন এবং ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সেখানে উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে তারা মতবিনিময় করেন। সংঘর্ষ ও উত্তেজনা বর্তমানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে।
কেকে/এআর