কুমিল্লার মুরাদনগরে মা ও তার ছেলে-মেয়েকে কুপিয়ে, পিটিয়ে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আসামিরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। যে কারণে বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে নিহতদের পরিবার ও স্থানীয়রা।
চলতি বছরের গত ৩ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ুইবাড়ি গ্রামে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনার ৫২ দিন পার হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাত্র ১১ জনকে গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতারকৃত ১১জন কুমিল্লা কারাগারে রয়েছেন। এর আগে এ হত্যাকাণ্ডের ৩৯ ঘণ্টা পর নিহত রুবির বড় মেয়ে রিক্তা আক্তার বাদী হয়ে বাঙ্গরা বাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শিমুল বিল্লাহকে প্রধান আসামি করে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ২০/২৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল।
বিচার পেতে দুয়ারে দুয়ারে স্বজনরা:
সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় নিহতদের পরিবারের নারী-শিশুসহ আটজন সদস্য। কিন্তু কুপিয়ে ও পিটিয়ে রোকসানা আক্তার রুবি, তার ছেলে রাসেল মিয়া ও মেয়ে জোনাকি আক্তারকে হত্য করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দুইদিন পর নিহত রুবির বড় মেয়ে রিক্তা আক্তার একটি মামলা করেন বাঙ্গরা বাজার থানায়। এ মামলা করার পর থেকে স-পরিবারে পলাতক তারা। মা, ভাই ও বোন হত্যার বিচার দাবি ও নিরাপত্তার আশায় প্রশাসনসহ বিভিন্ন জনের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে দেখা গেছে তাদেরকে। জীবনের নিরাপত্তা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে রিক্তা ও তার আহত বোন রুমা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করেছে।
রুমা আক্তার মুঠোফোনে বলেন, আমি পালিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমার মাথায় ৭২টি সেলাই দিতে হয়েছে। আমরা বাঁচতে চাই। জীবনের নিরাপত্তা চাই। স্বজন হত্যার বিচার চাই। কিন্তু আমরা কোন কিছুই পাচ্ছিনা। রুমা আক্তারের বড় বোন রিক্তা আক্তার বলেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবাসহ তার লোকজন আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তা না হলে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে কেন এখনো গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলছে রাজনীতি:
কড়ুইবাড়ি গ্রামের আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলছে রাজনীতি। এই রাজনীতির কারণে ফেঁসে যাচ্ছেন কড়ুইবাড়িসহ আশপাশের ৫/৬ গ্রামের নিরীহ মানুষ। পুরুষরা থাকতে পারছেনা নিজের বাড়ি-ঘরে। নাম না প্রকাশের শর্তে কড়ুইবাড়ি গ্রামের অন্তত ১০ জন স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অদৃশ্য ব্যক্তি রাজনীতি করছেন। যে কারণে মূল আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
থমথমে কড়ুইবাড়ি:
হত্যাকাণ্ডে ১ মাস ২২ দিন পরেও কড়ুইবাড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যে কারণে এ গ্রামে বাড়েছে চুরি-ছিনতাই। গ্রামবাসী বলছেন, এ গ্রামের আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের মূল পরিকল্পনাকারী আসামিদের গ্রেফতার না করায় কড়ুইবাড়িতে এ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কড়ুইবাড়ি কুদ্দুস মিয়া নামে একজন বৃদ্ধ বলেন, আগে কি সুন্দর ছিল কড়ুইবাড়ি। এখন কি থেকে কি হয়ে গেল। আমাদের গ্রাম এই অভিশাপ থেকে কবে মুক্তি পাবে। যদি আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার করা না হয়, তাহলে গ্রামে আবার শান্তি ফিরবেনা।
আসামির সাথে উপদেষ্টার বাবার ছবি ভাইরাল:
কড়ুইবাড়ির গ্রামের আলোচিত এই ট্রিপল মার্ডারের মূল পরিকল্পনাকারী আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা শিমুল বিল্লাহর সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাবা বিল্লাল হোসাইনের একটি ছবি হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ছবি নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তবে উপদেষ্টা আসিফের বাবা বিল্লাল হোসাইনের দাবি, এই ছবিটি হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার ছয় মাস আগের।
পরিকল্পনাকারী গ্রেফতার হয়না কেন:
এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা শিমুল বিল্লাহসহ অন্য মূল পরিকল্পনাকারীদেরকে এখনো গ্রেফতার করতে পারিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১১ জন। পরিকল্পনাকারীরা গ্রেফতার হয়না কেন জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপপরিদর্শক নয়ন কুমার চক্রবর্তী বলেন, হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি শিমুল বিল্লাহসহ অন্য আসামিরা আত্মগোপনে রয়েছে। যে কারণে তাদেরকে গ্রেফতারে বিঘ্ন হচ্ছে। আসামিদের গ্রেফতারের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করি খুব দ্রুত অপরাধীরা গ্রেফতার হবে।
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, যেখানে উপদেষ্টা আসিফ একটি ভিডিওর মাধ্যমে কড়ুইবাড়ির ট্রিপল মার্ডারে মূল পরিকল্পনাকারী আওয়ামী লীগ নেতা শিমুল চেয়ারম্যানকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছে। সেখানে শিমুল চেয়ারম্যানসহ অন্য আসামিরা কেন গ্রেফতার হয় না এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় একটি ফেক আইডির বরাত দিয়ে কায়কোবাদ দাদার ছোট ভাইকে নিয়ে অপপ্রচার করেছে আসিফ মাহমুদ। অথচ এই ফেইক আইডির বিরুদ্ধে থানায় জিডি এবং পত্রিকায় নিউজও হয়েছিল। উপদেষ্টা আসিফ অপরাধীদের রক্ষা করে উধোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপতে চায়।
কুমিল্লা পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমেদ খান বলেন, মুরাদনগরের ট্রিপল মার্ডারের তদন্তকারী কর্মকর্তা নিরপেক্ষ এবং সঠিকভাবে তদন্ত করে যাচ্ছেন। যারা অপরাধী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। আর ভিকটিমরা কোথায় নিরাপত্তা পাচ্ছেননা।
কেকে/ এমএস