রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে নেসকো (নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি) কর্তৃক প্রিপেইড মিটার স্থাপন কার্যক্রম নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রচার-প্রচারণা ও গ্রাহককে উৎসাহিত করার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, জোরজবরদস্তি ও নানা অজুহাত দেখিয়ে এই মিটার স্থাপন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গ্রাহকরা বলছেন, এই ডিজিটাল প্রিপেইড মিটারে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের চার্জ কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে মাস শেষে বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। শুধু তা-ই নয়, পুরোনো সচল মিটার বাদ দিয়ে জোর করে বসানো হচ্ছে নতুন মিটার। তাদের দাবি, এটি একটি ‘লুটপাট প্রকল্প’, যা বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রিপেইড মিটার প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী মুসা বলেন, “জনগণের মতামত উপেক্ষা করে এভাবে প্রযুক্তি চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই সাথে ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের এই প্রকল্প দ্রুত বাতিলের দাবি জানান তিনি ”।
প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলনে নামা এক গ্রাহক আইয়ুব আলী জানান, “আমরা পরিষ্কার বলেছি আমরা এই মিটার চাই না। তারপরও ভয় দেখিয়ে, চাপ দিয়ে এই মিটার বসানো হচ্ছে। এর ফলে বিগত সময়ে জনগণের টাকায় কেনা যে সচল ডিজিটাল মিটার গুলো অপসারণ করা হচ্ছে তাতে কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। যার বোঝা জনগণকেই ভুগতে হবে ”।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ডিজিটাল প্রিপেইড মিটার প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৮ সালে। প্রায় ৮৭৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকার এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। পরবর্তীতে সময় বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও ক্ষমতাসীন শেখ পরিবারের কয়েকজন সদস্যের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল এই প্রিপেইড মিটার বাণিজ্য। এ পর্যন্ত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে প্রায় ৬ লাখ মিটার বসানো হয়েছে, এবং আরো সাড়ে ৮ লাখ মিটার স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে নিম্নমানের প্রিপেইড মিটার স্থাপনের বিষয়ে ভোক্তা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ জুন নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চিঠিতে সাত কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তবে নেসকো এই চিঠির কোনো জবাব না দিয়ে ৪ জুলাই একটি অফিস আদেশ জারি করে, যেখানে বলা হয় নতুন সংযোগ ও পুরনো মিটার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারই ব্যবহার করা হবে।
এ বিষয়ে বিইআরসির উপ-পরিচালক রফিকুল আলম ভূইয়া বলেন, “আমরা নিয়ম অনুযায়ী চিঠি দিয়েছি, কিন্তু তারা এখনো উত্তর দেয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আবারও চিঠি দেয়া হবে। জবাব না দিলে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” নেসকোর প্রকল্প পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, “এটি সরকারের অনুমোদিত প্রকল্প। আমরা এটি বাস্তবায়ন করবো। না বুঝেই এটা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রি পেমেন্ট মিটার ছাড়া গ্রাহকরা যেন অন্য কোন মিটার প্রত্যাশা না করেন।"
এদিকে বুধবার রংপুর জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে প্রি পেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রসঙ্গে একটি অবহিতকরণ সভার আয়োজন করা হয়। এ সময় প্রি পেমেন্ট মিটার প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিচালক হাসিবুর রহমান দাবি করেন, না বুঝেই অনেকে আন্দোলন করছেন এবং ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। তার এমন বক্তব্যে পরই তোপের মুখে পড়েন। আমন্ত্রিত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলেন, সরকারি অফিস আদালত কিংবা বড় বড় কোম্পানি বাদ দিয়ে কেন সাধারণ গ্রাহকদের উপর স্মার্ট প্রিপেইড মিটার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্প দ্রুত বাতিলের দাবি জানান তারা। আলোচনা শেষে জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল বলেন, জোর করে কাউকে প্রিপেইড মিটার চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কেউ স্বেচ্ছায় নিতে চাইলে সেটি তার ব্যক্তিগত সদিচ্ছা। একই সাথে তিনি বলেন, নেসকের কেউ আইন অমান্য করে গ্রাহকদের দুর্ভোগে ফেলতে চাইলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেকে/এআর