সাম্প্রতিক রাজধানী উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সামরিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আলোচনায় এসেছে দেশের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা। প্রকাশ পেয়েছে আহতদের চিকিৎসা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক সেবার ঘাটতিও। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কাঠামো ও দক্ষতা নিয়ে। স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য কাঠামো এ ধরনের বিপর্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুত নয় এটি ছিল অন্যতম উদাহরণ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের বক্তব্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পর আশপাশের কিছু হাসপাতালে আহতদের নেওয়া হলেও বেশ কয়েকজনকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য একাধিক হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সময় নষ্ট হওয়ায় অনেকের অবস্থার অবনতি ঘটে। এমনকি দ্রুত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ফলে কয়েকজন আহতের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পোড়া রোগীদের জন্য দুর্ঘটনার পর প্রথম এক ঘণ্টা; যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলা হয়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে প্রাণহানির আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। যদিও আমরা এখনো সেই প্রস্তুতিতে নেই। এ ছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দেওয়া আমাদের দেশে এখনো নির্ভর করছে ব্যক্তি উদ্যোগ আর চিকিৎসকদের মানবিকতায়। কাঠামোগত সমর্থন বা ট্রেইনড ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম এখনো গড়ে ওঠেনি।
এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল ঘটনার রাতে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে জনতার ভিড়, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতি হাসপাতালের কার্যক্রমে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে পড়ে যে, পরদিন প্রশাসনকে হাসপাতাল এলাকায় প্রবেশে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়। এসব ঘটনা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যবিদরা বলেন, ‘এ ঘটনাই প্রমাণ করে, আমরা জরুরি স্বাস্থ্যসেবাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। তাদের মতে, দুই-একটি বাদ দিলে দেশে এখনো পর্যন্ত কোনো হাসপাতালেই পূর্ণাঙ্গ ইমার্জেন্সি রেসপন্স ইউনিট গড়ে ওঠেনি। যারা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন, তারা মূলত নিজের অভিজ্ঞতা ও মানবিকতা দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেন।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে ‘ইমার্জেন্সি হেলথ প্রফেশনাল’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামীতে স্বাস্থ্যশিক্ষায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে এক বা একাধিক প্রজন্ম গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্যারামেডিক, অ্যাম্বুলেন্স ও হেলিকপ্টারসহ পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা তৈরিতে এখনো সময় প্রয়োজন।
জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনায় আহত অনেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। যাদের অনেকের পরিস্থিতি হাসপাতালে আসার আগেই খারাপ দিকে গিয়েছিল। তিনি বলেন, বার্নের রোগীর ক্ষেত্রে ফ্লুইড রিসাসিটেশনটা আপনি যদি উইদিন আওয়ার (ঘণ্টার মধ্যে) শুরু করতে পারেন তাহলে তার রেজাল্টটা অনেক ভালো হয়। তার সারভাইবল রেশিওটা (বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা) অনেক বেড়ে যায়। তবে পোড়া রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বিশ্বমানের না হলেও ভালো সক্ষমতা রয়েছে বলেও দাবি হাসপাতালটির পরিচালকের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, মাত্র দুই-চারটা বড় হাসপাতাল ছাড়া আমাদের ইমার্জেন্সি রেসপন্সটা মূলত চিকিৎসক, নার্স তারা যে আন্তরিকতাটুকু দেখায় সেটার ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল।
জরুরি চিকিৎসা কেবল হাসপাতাল কেন্দ্রিক নয় বরং যেখানে ঘটনা ঘটবে সেখানেই যদি এটা শুরু হয় তাহলে আরো অনেক মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো বলেও মনে করেন তিনি। ডা. বে-নজির বলেন, স্বাস্থ্য ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রে আমাদের রেসপন্সটা সংগঠিতভাবে হয় না বলেই মৃত্যুর সংখ্যাটা বেড়ে যায়।
অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাবও দেখছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার যতটুকু সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসায় করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষেত্রে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ব্যুরোর সঙ্গে মিলে কাজ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার। যেখানে সামরিক বাহিনী, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, রেড ক্রিসেন্ট এবং স্বাস্থ্য বিভাগ যুক্ত থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বিমান বিধ্বস্তের এ ঘটনায় এটা তাৎক্ষণিকভাবে এক্টিভেট (চালু) না করে পরে করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ডেমোলিশন ইউনিট এখানে আসছে ঠিকই কিন্তু হেলথকে এখানে যুক্ত করে নাই। হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করে করেছে। এক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই দুষছেন এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছেন, আমাদের সব চিন্তা হলো হাসপাতাল কেন্দ্রিক। কিন্তু হাসপাতাল তো বেসিক ইউনিট। এটা কোঅর্ডিনেশন করার জন্য তো মেকানিজম আছে।
জরুরি স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি স্থায়ী কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে করোনার পর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি নিয়ে আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন তারা। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে আসা পর্যন্ত দেশে জরুরি সেবা দেওয়ার সক্ষমতা দুর্বল। তবে হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা বড় শহরগুলোতে বর্তমানে ভালো বলেই মনে করেন তিনি।
কেকে/ এমএস