রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। ওইদিনই পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিনদিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে গেল, কিন্তু বিপুল জনপ্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সাফল্য দেখাতে পারেনি সরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, সংস্কার ও বিচারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়াসহ নানা কারণে উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে। এমনকি খোদ জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররাও অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন।
সর্বশেষ মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও উপদেষ্টারের ব্যর্থতা নতুন করে সমালোচনার মধ্যে ফেলেছে সরকারকে। এ ঘটনায় সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। এতে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গত সোমাবার দুই উপদেষ্টাকে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখেন। তারা শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে সারা দিন কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। এ ছাড়া শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগের দাবিতে একদল শিক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে পড়েন। এ সমায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সচিবালয় এলাকা।
এসব ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পদত্যাগ চেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকাল বুধবার দুপুরে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির পথসভায় তিনি এ দাবি তোলেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর তোপ দাগান তিনি।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘এই সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। অভ্যুত্থানের পর আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আগের মতো, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও আগের মতো। একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী (উপদেষ্টা) আছে, চেনেন ওনাকে? উনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই-ব্রাদার কোটায় আসছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বজনপ্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা। সব সময় বলে আসছি, এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কোনো প্রয়োজন নাই।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসা সম্পর্কে ‘কিছু বোঝেন না’ বলে মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক হাসনাত। তিনি বলেন, ‘ওনার একমাত্র যোগ্যতা উনি গ্রামীণ ব্যাংকে ছিলেন এবং ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছের মানুষ। এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা লইয়া আমরা কী করিব? এবং দুঃখজনক বিষয়, উনি নিজে চিকিৎসা করাইতে সিঙ্গাপুর যান। আমরা বললে বিড়াল বেজার হয়। ওনাকে নিয়ে একবার কথা বলছিলাম, এরপর উনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। জনগণ ওনাকে যে বেতন দিচ্ছে, সেগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে এই স্বাস্থ্য উপদেষ্টার অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।’
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে সরকারের সমালোচনা করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। তিনি বলেন, ঘটনার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সরকারের আরো মানবিক এবং দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম। গত সোমবারের ঘটনার পর থেকে যা যা হয়েছে, সেখানে আরো দায়িত্বশীল হলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না।
সঠিক তথ্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করতে হবে। তথ্য নিয়ে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে। সরকারের কাছে যতটুকু সত্য তথ্য আছে, সেটি সঠিকভাবে প্রকাশ ও প্রচার জরুরি। এতে গুজব ছড়াত না। শিক্ষা উপদেষ্টার সমালোচনা করে নাহিদ বলেন, শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্বশীল আচরণ না থাকায় একটি সিদ্ধান্ত নিতে রাত ৩টা বেজে গেল। জরুরি মুহূর্তে সরকারের অন্য উপদেষ্টারা তাকে ফোন করে পাননি। এমন যদি সমন্বয়হীনতা থাকে সেক্ষেত্রে সমস্যা হবেই। এ সময় মাইলস্টোন শিক্ষার্থীদের দেওয়া ৬ দফা দাবির সঙ্গেও একাত্মতা পোষণ করেন তিনি। মাইলস্টোনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মরদেহ গুমের অভিযোগ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, গতকাল রাত থেকেই মরদেহ গুমের একটি অভিযোগ ওঠে। এক্ষেত্রে সরকার স্কুল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ওই সময় কতজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন, কতজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, কতজন নিখোঁজ রয়েছেন এসব বিষয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারতেন। পাশাপাশি সময় ব্যবধানে তথ্য আপডেটের মাধ্যমে সঠিক তথ্য সবাইকে জানাতে পারত।
দুই উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ রাখে শিক্ষার্থীরা
গত মঙ্গলবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। পরে সন্ধ্যায় পুলিশের পাহারায় বের হন তারা। গত সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আটকে ছিলেন তারা। বাইরে চলছিল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। বিকালে একবার কলেজ থেকে বের হওয়ার পর দিয়াবাড়ি মোড়ে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে ফিরে এসেছিলেন দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব। এরপর তারা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ভবন ৭-এর দ্বিতীয় তলায় অবস্থান নেন। তাদের গাড়িগুলো কলেজ ক্যাম্পাসে রাখা হয়। তখন থেকে একাডেমিক ভবন ৭-এর পাশাপাশি ভবন ৫-এর সামনেও ব্যাপকসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। পাশাপাশি র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিদেরও ক্যাম্পাসে সক্রিয় দেখা যায়।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হঠাৎ করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা বেড়ে যায়। একপর্যায়ে নিচে নেমে আসেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সদস্যরা। সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে তারা কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। কলেজের প্রধান ফটক থেকে বের হয়ে তাদের গাড়িবহর দিয়াবাড়ির মেট্রোরেলের ডিপো দিয়ে পার হয়ে যায়।
গত সোমবার দুপুরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। উদ্ধার তৎপরতা চলার সময় মাইলস্টোনের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা গত সোমবার সকাল ৯টায় ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, সি আর আবরার ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যান। তারা সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে ধরেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে বিকাল সাড়ে তিনটার কিছু আগে কলেজ থেকে বের হন দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। এ সময় কলেজের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদেরও দেখা যায়নি। উপদেষ্টাদের গাড়ি দিয়াবাড়ি মোড়ে গেলে বিকাল পৌনে চারটার দিকে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে নানা স্লোগান দেন। তাদের বাধার মুখে দুই উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মাইলস্টোনে ফিরে এসে একাডেমিক ভবনে অবস্থান নেন।
কেকে/এআর