বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ক্রমশই বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় ঢাকায় চালু করা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির বিষয়ে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তারই সর্বশেষ প্রমাণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রভাব শুধু উন্নয়ন সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণ ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা এ সিদ্ধান্তকে মানবাধিকার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব জোরদারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এ পদক্ষেপ বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সংকটাপন্ন দেশগুলোর কাতারে ফেলবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বিদেশি বিনিয়োগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বড় ইমেজ সংকটে পড়বে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের ১৮ দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় রয়েছে, বাংলাদেশ যদি সেই তালিকায় চলে যায়, তাহলে এটা আমাদের জন্য বিরাট ইমেজ সংকট হবে। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব বিনিয়োগের ওপর পড়বে। বিনিয়োগকারীরা তখন বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে অন্য দেশে চলে যাবে। এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।’
তথ্য বলছে, বর্তমানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের স্থায়ী কার্যালয় রয়েছে ১৬ দেশে, যেগুলোর বেশিরভাগই আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। এসব দেশ বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় কিংবা গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে। দেশগুলো হলো বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সিরিয়া (লেবাননের বৈরুত থেকে পরিচালিত), সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন। এর বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউক্রেনেও ওএইচসিএইআরের পৃথক কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত ৯টি দেশেও সংস্থটি কাজ করছে, তবে সেগুলো আলাদা কাঠামোতে পরিচালিত হয়।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া বা মেক্সিকোর যে ভয়াবহ অবস্থা তাদের সঙ্গে যদি বাংলাদেশকে এক কাতারে ফেলা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় নেই। বাংলাদেশে এভাবে হঠাৎ করে একটি অফিস চালু হলে এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে। এমনিতেই বাংলাদেশিদের জন্য অনেক দেশ ভিসা পাওয়া কঠিন করে দিয়েছে, এ সিদ্ধান্তে তা আরো কঠিন হতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানবাধিকারের অবস্থা এত খারাপ নয় যে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় স্থাপন করতে হবে। এর ফল ভালো হবে না।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। অথচ দেশটি এখনো জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রটোকলে সই করেনি। একইভাবে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারসংক্রান্ত কনভেনশনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকেও বাংলাদেশ এখনো বিরত রয়েছে, যেগুলো জাতিসংঘ অগ্রাধিকারভিত্তিতে বিবেচনা করে।’
তার মতে, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপিত হলে সংস্থাটি এসব কনভেনশনে বাংলাদেশের সই নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতপার্থক্য ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে স্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির যে বিধানের কথা বলা হয়েছে।
মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে ইসলামপন্থি দলগুলো। হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সরাসরি হুমকি দিয়েছে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে বৃহত্তর কর্মসূচিতে যাবে। তাদের দাবি, এ সংস্থার কর্মকাণ্ডে এলজিবিটি অধিকার, নারী শরীরনীতি এবং ধর্মীয় আইন-আদর্শে হস্তক্ষেপের ঝুঁকি রয়েছে। এনসিপি, খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য সংগঠন এটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
গত শনিবার এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ বলেছে, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেওয়া হবে না।’ চুক্তি বাতিল না করলে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, ‘অতীতেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সেই প্রবণতা স্পষ্ট। এ ছাড়া এলজিবিটি ইস্যুকে ওএইচসিএইচআরের মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবে তুলে ধরা নিয়েও আমাদের গভীর উদ্বেগ রয়েছে।’
এর আগে শুক্রবার রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি ইমতিয়াজ আলম বলেন, ‘ফিলিস্তিন, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনে এ কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার শেখাতে চায়?’ শনিবার কুড়িগ্রামের এক সমাবেশে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘দিল্লির দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙেছি ওয়াশিংটনের দাসত্ব করার জন্য নয়।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক শুল্কের চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টার মধ্যে দেশটি থেকে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ। গতকাল রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এ সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি পূরণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যে ১ আগস্ট থেকে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতদিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, এখন নতুন করে আরো ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ায় এটি দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে।
শুল্কের খড়গ থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ চাইছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ভারত, রাশিয়া, বেলারুসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় গম আমদানি করা হয়।
খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এই সমঝোতা পারস্পরিক আস্থা ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও আমেরিকা উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবেন।’
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে করে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বাড়বে, যা ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মতে, মানবাধিকার, খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব এ তিনটি খাতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করছে। এটি শুধু সাহায্য বা উন্নয়ন সহযোগিতা নয়; বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানে মার্কিন প্রভাব জোরদারের সুপরিকল্পিত কৌশল। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে গভীরভাবে যুক্ত হতে চায় এটি চীন-রাশিয়ার বিপরীতে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করার অংশ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ওএইচসিএইচআর মিশন কোনো সামাজিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নয়; বরং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের প্রতিরোধ এবং অতীতের দায়মুক্তির সংস্কৃতি রোধেই এটি কাজ করবে।’
তবে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের কৌশলগত প্রভাব বৃদ্ধির বাস্তবতা অস্বীকার করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে যেভাবে বাড়ছে, তাতে সরকারের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ আরো বেড়েছে। মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রম, গম আমদানির দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, শুল্ক পুনর্নির্ধারণ সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যেন এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। এ বাস্তবতা ইতিবাচক না নেতিবাচক তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বের আড়ালে কৌশলগত ও আদর্শিক চাপ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে ঢাকাকে।
কেকে/ এমএস