২১ জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশ এক ভয়াবহ সহিংসতা ও উত্তেজনার দিন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এদিন সারা দেশে গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়, যার জেরে ব্যাপক সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দেশজুড়ে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতার আবহের মধ্যেই এদিন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। কারফিউ এবং সাধারণ ছুটির মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগের কার্যক্রম বসে, যা দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।
কারফিউ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা : দেশজুড়ে সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার কারফিউ জারি করে এবং সারা দেশের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। এ নজিরবিহীন পদক্ষেপের কারণে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা ছিল যে এমন জরুরি পরিস্থিতিতে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায় : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ এদিন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল (রদ ও রহিত) করা হয়। এই রায়ের ফলে, নিয়োগে ৭ শতাংশ কোটা বহাল রেখে ৯৩ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ কোটা। প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা। আদালত আরো জানান, এ নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
সহিংসতা ও প্রাণহানি : সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পাশাপাশি ২১ জুলাই ছিল দেশজুড়ে চরম সহিংসতার একটি দিন। চলমান কারফিউ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ৪ জন নরসিংদীতে, ২ জন গাজীপুরে এবং নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও চট্টগ্রামে একজন করে নিহত হন। শত শত মানুষ আহত হন, যাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চালায়। সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯টি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা যেমন বাড্ডা, কুড়িল, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুরে দিনভর বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ : চলমান পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘দেখা মাত্র গুলি’ করার নির্দেশ দেয় বলে জানা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে ৫৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যার মধ্যে প্রায় ২০০ জন ঢাকার। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাও রয়েছেন।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ১৯ জুলাই গভীর রাতে খিলগাঁও এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ২১ জুলাই ভোরে তাকে পূর্বাচল এলাকা থেকে খুঁজে পাওয়া যায় এবং পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০ জুলাই রাত ৮টার দিকে ও পরদিন সকালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বাসভবনে দুবার হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা, এতে বাড়ির বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী কর্মসূচি : চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ জন সমন্বয়ক একটি যৌথ বিবৃতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের জানান। বিবৃতিতে তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি আরো জোরদার করার আহ্বান জানান। তারা অভিযোগ করেন যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এবং ‘তিন শতাধিক’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার অভিযোগ করা হয় তাদের বিবৃতিতে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে এবং সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। এ ছাড়া সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদারসহ কয়েকজনের সন্ধান দাবি করা হয়।
এ ছাড়া পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ৩১ জুলাই পর্যন্ত তাদের সকল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ২১ জুলাই সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে ২২ জুলাই গায়েবানা জানাজার ডাক দেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি আন্দোলনের বিচার ও ক্ষতিপূরণসহ আট দফা দাবির বাস্তবায়নও চাওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর জরুরি বৈঠক : ২১ জুলাই রাতে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গণভবনে সামরিক-বেসামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন বলে জানা যায়।
কেকে/ এমএস