গত বছরের ৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনের। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ওই দিনই পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে অবসান ঘটে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার। জুলাইতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অভ্যুত্থানের সূচনা বলে এটি পরিচিতি পায় ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ নামে। চলতি জুলাইয়ে এ আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি পালন করছে।
স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারে পতন ঘটাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গড়ে ওঠে বাংলাদেশে। তবে এক বছরেই ফাটল ধরেছে এ ঐক্যে। জুলাই অভ্যুত্থানের বেশিরভাগ আকাক্সক্ষাই এখনো অধরা রয়ে গেছে। এই এক বছরে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ এজেন্ডায় ফিরে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের অনেকেই দুর্নীতিসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। ছাত্রদের গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ধারাবাহিকভাবে বিচার ও সংস্কারের দাবি তুললেও গণ-আকাক্সক্ষা ধারণে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে, দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের দাবি নিয়েই বেশি মুখর। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোও দলীয় এজেন্ডা মাথায় রেখেই কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দেশবাসী দেখেছিল নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। আকাক্সক্ষা করেছিল নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ উঠছে। এমনকি এনসিপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে তদবিরবাণিজ্যসহ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র পরিবর্তনের বদলে ক্ষমতায় যাওয়া নিয়েই বেশি আবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনের দাবিই তাদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। সংস্কার ছাড়া, নতুন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া শুধু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল দেশে কোনো পরিবর্তন আনবে না। বরং অধরাই থেকে যাবে জুলাই চেতনা।
জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়াই নতুন প্রজন্মের ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বিজয়ের পর থেকে নানা পক্ষ সেই আকাক্সক্ষা থেকে সরে গেছে।’
গত বছরের ৫ আগস্টের পরপরই বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলের অভিযোগ ওঠে। এমনকি নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন অনেকে। এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। দেশের বেশ কিছু জায়গায় নারী নির্যাতনসহ ধর্ষণকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ ভোলায় স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দলটি যে কোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাতে তৃণমূলের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাও। এমন অভিযোগে কয়েকজনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ফেনীতে এক মাদ্রাসাশিক্ষকের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় এক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার নাম জাকির হোসেন মিয়া। তিনি জামায়াতের রুকন এবং দলের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ফেনী পৌরসভা শাখার সাবেক সহকারী সেক্রেটারি। জামায়াতে ইসলামী ফেনী জেলা শাখার প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক আ ন ম আবদুর রহিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জাকির হোসেনকে বহিষ্কারের বিষয়টি জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংগঠনের শৃঙ্খলা ও নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় দলীয় গঠনতন্ত্রের ৬২ নম্বর ধারার ২ উপধারা অনুসারে জাকির হোসেন মিয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় জামায়াতের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন স্থানীয় ধনাঢ্য এক ব্যবসায়ী। শুধু এ দুটি ঘটনা নয়, সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জামায়াত নেতাদের চাঁদাবাজির কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের সোপান হিসেবে দেখছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা সংগ্রহ করছেন তারা। অনেক ক্ষেত্রে চাঁদার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন তারা। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়নেও চাঁদাবাজি করছে সংগঠনটি।
অন্য ইসলামি দলগুলোও জুলাই চেতনা ভুলে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। দেশে মব তৈরি করে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দেশের কয়েকটি স্থানে নারীদের ওপর সহিংসতায় ও নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধে মব সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে ইসলামি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
এদিকে, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ছাত্রদের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। পঞ্চগড়ে সারজিস আলমের গাড়িবহর নিয়ে শোডাউন দেশব্যাপী সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া তদবিরবাণিজ্যসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং এনসিপির সাবেক নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গত ২১ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুর্নীতির অভিযোগে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন এনসিপির সাবেক নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীর।
এনসিপির সাবেক নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- এনসিটিবিতে কাগজ সরবরাহে ৪০০ কোটি টাকা কমিশন নিয়েছেন। এ ছাড়া ডিসি নিয়োগে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আছে এনসিপির সাবেক এ নেতার বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবী ও ডাক্তার মাহমুদুল হাসানের তদবিরবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।
কেকে/এআর