বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? পুকুর ধারে লেবুর তলে, থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতার জোনাকি পোকা এখন আর মিটমিট করে জ্বলে না। আলো জ্বালানো নিশাচর প্রাণীটি আজ বিলুপ্তের পথে।
এই তো কয়েক দশক আগের কথা বনে, শালিখা উপজেলার গঙ্গারামপুর, বুনাগাতী, শালিখা, ধনেস্বরগাতীসহ বিভিন্ন এলাকার পুকুর, ডোবা, নালা, খাল-বিল, নদী পাড় ধরে গজিয়ে ওঠা ঘাস ও ঝোপঝাড়ে, বনবাদাড়ে, ঝোপঝাড়ে সন্ধ্যা হলেই মিটিমিটি আলো জ্বালিয়ে মেয়ে জোনাকির সঙ্গে ভাব বিনিময় করত পুরুষ জোনাকি। গড়তো বন্ধুত্ব করতো কাঙ্ক্ষিত মিলন।
জোনাকির এই আলোর খেলা দেখতে সন্ধ্যা হলেই স্থানীয়রা ছুটে যেত বনবাদাড় ও ঝোপঝাড়ের পাশে। কেউ কেউ জোনাকি ধরে করত বতল বন্দি, দেখতে জোনাকি পোকার অবিরাম দৌড়ঝাপ। এখন কমে গেছে জোনাকি, কমেছে তার মিটিমিটি আলো। প্রতিকূল পরিবেশ, বৈদ্যুতিক আলোর ঘনঘটা ও বনবাদাড় কমে যাওয়ায় জেনাকিরা আজ মরুর পথে।
জোনাকি কথাটির অর্থ জোনাকি পেকা। এটি এক ধরনের বিটিল শ্রেণির পোকা। ইংরেজিতে ওদের লাইটিং বাগ বা ফায়ার ফ্লাই বলে। ল্যামপাইরিডি পরিবারের বিটিল পোকাদেরই জোনাকি পোকা বলা হয়। ছোট্ট কালচে বাদামি রঙের পোকা, একটু লম্বাটে গড়নের। পোকার পেটের পেছনে থাকে সেই আলো জ্বলা অংশ। আমাদের দেশ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া-আমেরিকা পর্যন্ত অনেক দেশেই জোনাকি পোকা আছে। পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির জোনাকি পোকা আছে। প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকি পোকার আলো কিন্তু এক রকম নয়, আলাদা। কোন কোন জোনাকি পোকার আলোর রঙ সবুজ, কারো আলো হলুদ আবার কারো বা কমলা। শুধু রঙই আলাদা নয়, ওদের আলোক সংকেতও ভিন্ন ভিন্ন।
জোনাকিরা অবিরাম আলো জ্বালায় না। ওদের আলো জ্বলে আর নেভে। একটু গরম ও বর্ষা পড়তেই না পড়তেই জোনাকি পোকারা ওদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। জোনাকি পোকাদের মধ্যেও পুরুষ আর মেয়ে জোনাকি পোকা আছে। পুরুষ পোকারা মেয়ে পোকার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা মিলনের আশায় আলো জ্বেলে ঝোপঝাড়ে উড়তে থাকে। আর মেয়ে পোকারা ঝোপঝাড়ের নিচে, ঘাসের পরে, মাটিতে বসে পুরুষ পোকাদের জ্বালানো আলো দেখার অপেক্ষায় বসে থাকে। পুরুষ পোকারা আলো জ্বেলে ঘুরতে থাকে।
এসব আলো দেখে মেয়ে পোকা তার পুরুষ বন্ধুকে বেছে নেয়। কোনো পুরুষ পোকাকে পছন্দ হলে মেয়ে জোনাকিও একই রকম আলো জ্বালতে শুরু করে। এই আলো দেখে তারা একে অপরের কাছে আসে ও মিলনে যায়। অনেক প্রজাতির জোনাকি আছে। কিন্তু এক জাতের জোনাকি পোকার সঙ্গে অন্য জোনাকি পোকার আলোক সংকেত হুবহু মেলে না। তাই নির্দিষ্ট প্রজাতির জোনাকি পোকারাই সেসব আলোকসংকেত চিনে তার স্ব-জাতির পুরুষ পোকাদের সঙ্গে মিলতে পারে। সংকেত ঠিক মতো না চিনতে পারলেই বিপদ। এক প্রজাতির মেয়ে পোকা কখনো অন্য প্রজাতির পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না, ওটা ওদের সমাজে অন্যায়। জোনাকি পোকারা আলো জ্বেলে এক অপরের সঙ্গে সংকেত আদান প্রদানের মাধ্যমে কথা বলে, ভাববিনিময় করে। আলো না জ্বললে এটা কখনো সম্ভব হতো না। ফলে জোনাকিদেরও আর কোনো বাচ্চা হতো না। ফলে পৃথিবী থেকে জোনাকিরা হারিয়ে যেত।
জোনাকিদের পেছনে বা লেজে দুটো রাসায়নিক পদার্থ থাকে- লুসিফেরাজ ও লুসিফেরিন। লুসিফেরাজ একটি এনজাইম যা আলো ছড়ায়। আর লুসিফেরিন তাপ প্রতিরোধী যা আলোকে ঠান্ডা রাখে। জোনাকি পোকারা তার শক্তির শতভাগই আলোতে পরিণত করতে পারে। জোনাকির আলোতে কোন তাপ হয় না।
জোনাকি পোকার বাচ্চারা মাটিতে, গাছের বাকলের নিচে ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় থাকে। তারা সেখান থেকে কেঁচো, শামুকের বাচ্চা ও পচা জায়গায় থাকা অন্যান্য পোকার বাচ্চা খায়। এমনকি পচা প্রাণী ও আবর্জনাও খায়। বাচ্চারা দেখতে অনেকটা শুকনো পাতার মতো, তবে খুবই ছোট। বাচ্চাদের মুখে কাঁচির মত ধারাল এক রকমের অঙ্গ আছে। সেটা দিয়েই ওরা শত্রুকে ঘায়েল করে। শত্রুর আকার বড় হলে কয়েকজন মিলে তাকে আক্রমণ করে। মুখের ওই ধারালো অঙ্গ শিকারের দেহে ঢুকানোর সাথে সাথে ওরা এক ধরনের বিষ ছেড়ে দেয় যার প্রভাবে শিকার অবশ হয়ে যায়।
এরপর তারা সবাই মিলে সেটা খায়। বড় হওয়ার পর বাচ্চাদের চেহারা বদলে যায়। তখন তারা আলো জ্বালতে শুরু করে। তবে কোন কোন প্রজাতির জোনাকি পোকার বাচ্চা এমনকি ডিম থেকেও আলো বের হয়। জোনাকিরা বড় হলে তারা মাত্র কয়েক মাস বাঁচে। জোনাকির বাচ্চারা প্রায় এক বছর বাঁচে। কিন্তু বড়রা বাঁচে অল্পদিন বা কয়েক মাস। বড় মেয়ে জোনাকিরা মিলিত হওয়ার পর ডিম পাড়ার পরই মরে যায়, পুরুষরা মরে যায় মিলনের পরই।
আড়পাড়া ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি ঊলা কাজী বলেন, ছোটবেলায় অসংখ্য জোনাকি পোকার খেলা দেখেছি। জোনাকি পোকা ধরে কাচের বতলে বন্দি করতাম। সন্ধ্যা হলেই ঝাোপঝাড়ের কাছে গিয়ে জোনাকি পোকার খেলা দেখতাম, সাথে দেখতাম তাদের ভাববিনিময়। তখন অনেক ভালো লাগতো কিন্তু সেই জোনাকি পোকাগুলো এখন আর দেখা যায় না।
শ্রী ইন্দ্রনীল গবেষণা অ্যাসোসিয়েটস এর প্রধান সংগঠক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, জোনাকি পরিবেশের সৌন্দর্য ধারণকারী এক প্রকার পোকা যা সন্ধ্যা হলেই গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাগুলোকে আলোকিত করে। এটি শুধু পরিবেশের সৌন্দর্যই প্রস্ফূটিত করে না পাশাপাশি প্রকৃতপ্রেমী মানুষদের আকৃষ্ট করে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জেনাকিকে তুলে ধরতে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন।
ধীরে ধীরে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া আলোক দূষণের কারণে জোনাকি আজ বিলুপ্তির পথে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। তাই জোনাকিদের আবার ফিরিয়ে আনতে ওদের বসবাসের উপযোগী বাসস্থান তৈরি বা ঝোপঝাড় ও জলাভূমি রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে আবার আমাদের বাড়ির আশপাশে লেবু-করমচার ঝোপগুলো সন্ধ্যার পর হাজার জোনাকির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে।
কেকে/এএস