আচমকা ইরান আক্রমণের পর পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের তেল আবিব ও আশপাশের একাধিক শহর যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে ইরান। আয়রন ডোম, এরো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সব ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারেনি ইসরায়েল। তাদের এত দিনের অস্ত্র ও প্রযুক্তির দম্ভ চূর্ণ হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ২০ মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল, বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপে নিখোঁজ রয়েছে। অন্যদিকে ইরানের মৃতের সংখ্যা ১২৮ জন। গতকাল রাত ১০টায় এ রিপোর্টটি যখন লেখা হচ্ছে, তখনো ইসরায়েল ও ইরান পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছিল।
ক্ষয়ক্ষতিতে ইসরায়েলের দম্ভ চূর্ণ : মধ্য ইসরায়েলের একটি তেল শোধনাগার এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তেল শোধনাগারে আগুন লাগার দৃশ্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ছবি ইসরায়েলের দুর্বলতার প্রতীক। তারা এতদিন যে লৌহঢালের গর্ব করত তা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে ইরান। তবে ইরানের সেনাপ্রধানসহ ব্যাপক প্রাণহানি ও পরমাণু কেন্দ্রসহ বহু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদেরও নিরাপত্তা ঘাটতিও সামনে চলে এসেছে। এ দুটি দেশ এতদিন যে ভাবসাব নিত তা অনেকটাই স্নান হয়ে গেছে সর্বশেষ যুদ্ধে।
২০ ইসরায়েলির মৃত্যু, বহু নিখোঁজ : শনিবার দিবাগত রাতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আগের রাতে মারা গিয়েছিল ৭ জন। তবে গতকাল ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের নিচে অনেক মানুষ আটকা পড়েছে, নিখোঁজ হয়েছে বহুজন। গতকাল বিকালে ইরানের আরেক দফা হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পুরো বিবরণ পাওয়া যায়নি।
ইরান রাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে সরাসরি আঘাত হেনেছে। এতে অন্তত ১৩ জন নিহত ও ২০০ জন আহত হয়েছেন।
রয়টার্স জানায়, শনিবার ইসরায়েলের স্থানীয় সময় রাত ১১টার একটু পর ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়। এ সময় জেরুজালেম ও ইসরায়েলের হাইফা শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সতর্কতা জানিয়ে তীব্রস্বরে সাইরেন বেজে ওঠে আর লোকজন বোম্ব শেল্টারগুলোতে গিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে।
পরে রাত আড়াইটার দিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী আরেক পশলা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে বাসিন্দাদের সুরক্ষা কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার আহ্বান জানায়। হামলা প্রতিহতে ইন্টারসেপ্টর রকেট ছোড়া শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী, এ সময় বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে তেল আবিব ও জেরুজালেম। ইসরায়েলের আকাশজুড়ে দেখা যায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ঝলক।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় বন্দর শহর হাইফার নিকটবর্তী তামরা শহরের একটি ভবনে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে অন্তত চারজন নিহত হয়। নিহতদের সবাই এক পরিবারের নারী সদস্য বলে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে।
তেল আবিবের দক্ষিণের শহর বাত ইয়ামে আরেক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আরো ছয়জন নিহত হয়। এদের মধ্যে ৮ বছর বয়সি এক শিশু রয়েছে।
কয়েকটি ভবন ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ধারকারীরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিখোঁজদের সন্ধানে তল্লাশি চালাচ্ছেন। রাতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের কতগুলো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরিষ্কার হয়নি।
অন্যদিকে তিন দিনে ইরানের ২২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে সেনাপ্রধানসহ ২০ কমান্ডারও রয়েছে।
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রাণহানি কম : ইরানে নজিরবিহীন ইসরায়েলি হামলার পর পাল্টা জবাব দিচ্ছে তেহরান। হামলার তীব্রতাও বাড়ছে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণ এবং আগাম সতর্কতার কারণে ইসরায়েলে প্রাণহানি কম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ‘হোম ফ্রন্ট কমান্ড অ্যাপ’।
এই অ্যাপের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার ১৫-৩০ মিনিট আগেই সতর্কবার্তা পেয়ে যাচ্ছেন ইসরায়েলিরা। এরপর তারা আশ্রয় নিচ্ছেন বোমা সুরক্ষা কেন্দ্র (বোম্ব শেল্টার) ও নিরাপদ কক্ষে। প্রাণহানি এড়াতে ‘বোম্ব শেল্টার’ ও নিরাপদ কক্ষের কার্যকারিতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ‘হোম ফ্রন্ট কমান্ড’ শনিবার জানিয়েছে, তারা ইরানের সম্ভাব্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ১৫-৩০ মিনিট আগে ইসরায়েলিদের ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো শুরু করেছে, যাতে মানুষ বোম্ব শেল্টারে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পান।
হোম ফ্রন্ট কমান্ড অ্যাপের মাধ্যমে এ আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের বোম্ব শেল্টারের কাছাকাছি থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। সামরিক কর্মকর্তারা বলেন, যাদের বাড়িতে বোমা প্রতিরোধী কক্ষ নেই, তাদের সময়মতো আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে এটি সহায়তা করবে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর ইরান থেকে ইসরায়েলে পৌঁছাতে সাধারণত প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগে। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সাধারণত ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কয়েক মিনিট আগেই ইরানি সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতির ওপর ভিত্তি করে হামলার বিষয়টি শনাক্ত করতে পারে।
একবার নিশ্চিত উৎক্ষেপণ শনাক্ত হলেই হোম ফ্রন্ট কমান্ড তাদের অ্যাপ ও মুঠোফোন সম্প্রচার পদ্ধতি (সেল ব্রডকাস্ট সিস্টেম) উভয়টি ব্যবহার করে একটি আগাম সতর্কতা দেয়, যাতে বেসামরিক নাগরিকরা বোম্ব শেল্টারে যেতে পারেন। শুক্রবার থেকে এমনটি করে করে আসছে হোম ফ্রন্ট কমান্ড। এতে বেসামরিক নাগরিকরা আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিট সময় পাচ্ছেন।
ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার প্রায় ৯০ সেকেন্ড আগে সাইরেন বাজে। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের অবশ্যই তাৎক্ষণিক বোম্ব শেল্টারে প্রবেশ করতে হবে আর ‘অল-ক্লিয়ার (সবকিছু স্বাভাবিক)’ বার্তা না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকতে হবে।
শুক্র ও শনিবার ইরানের ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বেসামরিক এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণের পর হোম ফ্রন্ট কমান্ড জানিয়েছে, যারা বোম্ব শেল্টারে ছিলেন, হামলায় তাদের বেশির ভাগেরই কিছু হয়নি।
আর যারা নিহত হয়েছেন, তাদের বাড়িতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার সময় তারা বোম্ব শেল্টারে ছিলেন না।
পাল্টাপাল্টি হামলা করছে ইরান-ইসরায়েল : তেহরানে একাধিক গাড়িবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে ইসরায়েল-সম্পৃক্ত নাশকতাকারীরা। এর কিছুক্ষণ পর ইসরায়েলের দিকে লক্ষ্য করে অন্তত ৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, কিছুক্ষণ আগে ইরান থেকে ইসরায়েল লক্ষ্য করে আবারো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। ইসরায়েলের নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে বলা হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত হওয়ার পর দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় সতর্কতা সাইরেন বেজে উঠেছে। হামলা প্রতিহত করতে ও প্রয়োজনে পাল্টা হামলার জন্য তাদের বিমানবাহিনী অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েলের নাগরিকদের সেনাবাহিনীর দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিকট বিস্ফোরণে গতকালও কেঁপে ওঠে ইরানের রাজধানী তেহরান। রাজধানী তেহরানের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রোববার বিকালে শহরে আবারো কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ অনুভূত হয়েছে।
শহরের পশ্চিমাঞ্চলের একাধিক আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠতে দেখা গেছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি গাড়ি আগুনে পুড়ছে।তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা বা কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বিস্ফোরণের খবর আসার সময়ই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানায়, ইরায়নে আরো হামলা চলছে। আইডিএফের মুখপাত্র এফি ডেফরিন বলেন, ‘আমরা এক মুহূর্তের জন্যও হামলা বন্ধ করছি না। এ মুহূর্তেও তেহরানে আমরা বিভিন্ন নতুন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ইসরায়েলের দুই গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছে ইরান : ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করার কথা জানিয়েছে ইরান। আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দুই ব্যক্তি আলবোর্জ প্রদেশে বিস্ফোরক ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বানানোর সময় ধরা পড়েছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত ইরান এর আগেও বহুবার মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে ও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিশেষ করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ব্যাহত করতে নাশকতা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
কেকে/এআর