আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এপ্রিলে আয়োজনের ঘোষণাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো বলছে, এই সময়টি রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে একেবারেই অনুপযুক্ত। দলগুলোর দাবি এপ্রিলে নির্বাচন হলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ যেমন কমে যাবে, তেমনি ব্যাহত হবে প্রার্থীদের প্রচারণাও। এ ছাড়া এপ্রিল মাসে দেশে ধান কাটার মৌসুম থাকে। তখন গ্রামের অধিকাংশ কৃষক মাঠে ব্যস্ত থাকবেন। ফলে ভোটার উপস্থিতি কমতে পারে।
একই সময়ে চলবে রমজান ও ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি। দিনভর রোজা রেখে প্রচারণা চালানো, তারাবির পর রাতে মিটিং করা এসবই প্রার্থীদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। তাদের মতে এপ্রিলের আগে রয়েছে এসএসসি ও অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা, যা ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল-কলেজগুলোর কার্যক্রমে প্রভাব ফেলবে। আবার গরম আবহাওয়ায় ভোটগ্রহণও কষ্টকর হয়ে উঠবে।
অপরদিকে অন্য দলগুলোর ভাষ্য- একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্বে বসানো হয়েছে। যখন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে, তখনি যেন নির্বাচন দেওয়া হয়। যদি কোনো দলের চাপে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ হয়, তাতে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সরকার ব্যর্থ হবে।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধ্বে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে এই সময়সীমা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খোলা কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন তিনি আমাদের ইতিহাসের একটি সেরা নির্বাচন উপহার দিতে চান, তো কথা হচ্ছে সেরা নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য এপ্রিল মাস তো কোনো বিবেচনা-ই সেরা সময় নয়। তবে তিনি কেন এই সময়টাতেই নির্বাচনের তারিখ দিলেন সেটা এখনো বোধগম্য নয়, তিনি নিজেও তার বক্তব্যে তা ব্যাখ্যা করেননি। ফলে এই সরকার আদৌ নির্বাচন চায় কি না সেই প্রশ্নও বড়ভাবে উত্থাপিত হয়েছে। কারণ দেখা যাবে এরপরে যে দু’একটা দল এপ্রিলকে সমর্থন করছে; তারা পরে বলা শুরু করবে এপ্রিল মাসে তো আর নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ঝড়-বৃষ্টি, অকাল বন্যাসহ নানা সমস্যা। তাহলে ২৬ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই হোক। যা অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার কোনো কূটকৌশল কি না সেই প্রশ্নও ইতোমধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। সর্বোপরি বলা যায় কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব নয়, সে ব্যাপারে সরকার এখনো কোনো যুক্তি হাজির করতে পারেনি।’
প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা বলেছি বিচার কাজটা সরকার দৃশ্যমান ও কার্যকর করবেন, যার মাধ্যমে সরকার একটি প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করবে। আর এ ব্যাপারে আমরা সবাই জনগণের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংস্কারের ব্যাপারেও আমরা মনে করি জুন বা জুলাইয়ের মধ্যভাগেই যেটা ন্যূনতম ঐকমত্য হবে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা একমত হয়ে ‘জুলাই সনদ বা জাতীয় সমঝোতা সনদ’ স্বাক্ষর করব। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনেরও প্রস্তুতি রয়েছে ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে। এবার বাকি থাকে প্রশাসনিক প্রস্তুতি। সেটাও সরকার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে ডিসেম্বর কেন, তার আগেও নির্বাচন সম্ভব।’
এদিকে ডিসেম্বরে নির্বাচন- একটি দলের দাবি মন্তব্য করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্বে বসানো হয়েছে। আমরা চাই তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করুক এবং যখন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে, তখনই নির্বাচন দেওয়া হোক। এখন তিনি যদি কোনো দলের চাপে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করেন, তাহলে তো তার ওপর যে প্রত্যাশা সেটা পূরণ হলো না।’
জুলাই নির্বাচনের জন্য উপযোগী কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অতীতে দেখছি ডিসেম্বরে, ফেব্রুয়ারি এবং জুনেও নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ১২ জুন একটা নির্বাচন হয়েছিল, সেটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং ডিসেম্বরেই নির্বাচন হলে গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক হবে বিষয়টা কিন্তু এমন না।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘টাইম ইজ নট গুড ফর ইলেকশন। রোজা শেষ হবে, ঈদ শেষ হবে, তারপরই নির্বাচন এটা বাস্তবসম্মত সময় নয়। রোজার মাসজুড়ে ক্যান্ডিডেট, ওয়ার্কারদের কী অবস্থা হবে ভাবুন। ইফতার পার্টির খরচেও ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দিনে জনসভা হলে মানুষ গরমে আসতে চাইবে না, রাতে করতে গেলে আবার তারাবির সময় মিটিং দেওয়া সম্ভব না। এতে প্রচারণার গতি থেমে যাবে।’
কেকে/এএস