খুলনার সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজের শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম ক্লাস নেওয়ার সময় একটা কথা প্রায়শই বলে থাকেন—যাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসা যায়, (পরিস্থিতি বদলালে) তাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণাও করা যায়। এ কথাটা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা সম্প্রতি বদলে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ধনকুবের ইলন মাস্কের মধ্যকার সম্পর্কই প্রমাণ করে।
গত বছরের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রবেশ নিশ্চিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তার অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন বিজনেস ম্যাগনেট ইলন মাস্ক। ফলস্বরূপ ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘সরকারি ব্যয় দক্ষতা দফতর’ নামে নতুন একটি বিভাগ খুলে মাস্ককে দফতরটির প্রধান বানিয়ে পুরস্কৃতও করেছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বের ফলে সবথেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মার্কিন রাজনীতি।
ধনতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই
সহজাতভাবে পরিচালিত হয় অর্থের ঝনঝনানির মাধ্যমে। নির্বাচনি প্রচারণায় যে যত
বেশিসংখ্যক দাতা জোগাড় করতে পারবেন, তার জয়ের পাল্লা তত ভারী হবে
তবে চার মাসের মাথায় ট্রাম্প-মাস্কের অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক জুটিতে ধরেছে ভাঙন। সাম্প্রতিককালে ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল’ বলে খ্যাত রিপাবলিকান উত্থাপিত নতুন বাজেট প্রস্তাবনাকে ঘিরে হয়েছে এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বিলটিতে বৈদ্যুতিক যান বা ইলেকট্রিক ভিকেলের (ইভি) ওপর করা হয়েছে অতিরিক্ত কর আরোপ। আর এতেই চটেছেন বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার মালিক মাস্ক। যদিও তিনি মুখে সরকারের ব্যয় কমানো আর বাণিজ্য খাতে সুবিধা প্রদান প্রসঙ্গে বেশি বুলি আওড়াচ্ছেন, কিন্তু আদতে এর মাধ্যমে ভর্তুকি ও কর ছাড়ের বিষয়টির প্রতিই প্রাধান্য দিচ্ছেন তিনি।
ট্রাম্পও চুপ করে বসে নেই। তার চাপ প্রয়োগের কারণেই মাস্ক ‘সরকারি ব্যয় দক্ষতা দফতর’-এর প্রধানের পদ হতে পদত্যাগ করেছেন বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে পদে আসীন থাকা অবস্থায় ইলন মাস্কও কম যাননি। ব্যয় কমাবার কথা বলে ব্যাপক হারে সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাইকারি দরে চাকরিচ্যুত করেছেন তিনি। মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনতে চেষ্টা চালিয়েছেন মাস্ক। বিজ্ঞানীদের জন্য গবেষণা খাতের বরাদ্দও হ্রাস করেন এ মার্কিন ধনকুবের।
আর এসব কারণেই এক সময়কার দারুণ মিত্রতার প্রতীক ট্রাম্প-মাস্ক সম্পর্ক রূপান্তরিত হয়েছে বৈরিতার এক কালো পরিচ্ছেদে। তাই মাস্ক শুধু রিপাবলিকান বাজেট প্রস্তাবনার বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন ট্রাম্পকে। নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তাই মাস্ককে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন ট্রাম্পও।
কিন্তু সার্বিকভাবে বিশ্বের একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং এক শীর্ষ ধনীর মধ্যে সৃষ্ট এ দ্বন্দ্ব দেশটির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। একইসঙ্গে দরকার এ দ্বন্দ্বের ফলে ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যে কে বেশি বিপাকে পড়ছেন—সেই উত্তর খুঁজে বের করা।
প্রথমত, ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বের ফলে সবথেকে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মার্কিন রাজনীতি। ধনতান্ত্রিক এ রাষ্ট্রের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই সহজাতভাবে পরিচালিত হয় অর্থের ঝনঝনানির মাধ্যমে। নির্বাচনি প্রচারণায় যে যত বেশিসংখ্যক দাতা জোগাড় করতে পারবেন, তার জয়ের পাল্লা তত ভারী হবে—এ তো সবার জানা কথা।
আর সেখানে ইলন মাস্কের মতো বিশ্বের শীর্ষ ধনী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রচারণায় শুধু নামেননি, বরং তাকে অভিশংসনের ভয় দেখাচ্ছেন। হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ট্রাম্পবিরোধীদের মোটা অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেওয়ারও। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি হয়ে উঠেছে টালমাটাল।
দ্বিতীয়ত, দেশটির অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলেও ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বের জেরে উত্থান-পতনের সৃষ্টি হয়েছে। মাস্কের প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিরাট দরপতনের সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে মাস্ক যদি বদলা নিতে চান, তবে মুহূর্তেই রিপাবলিকান শিবিরসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে ট্রাম্পকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন তিনি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন ইলন মাস্ক।
তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে তা হলো জেফ্রি এপস্টেইন ফাইলে ট্রাম্পের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে এক্সে করা মাস্কের একটি পোস্ট। জেফ্রি এপস্টেইন হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কুখ্যাত অপরাধী। তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু পাচার এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ছিল। বড় বড় রাজনীতিবিদ ও ধনকুবেরদের সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে নারী ও কিশোরীদের বাধ্য করারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে ২০০৮ সালে সাজা পেলেও ১৩ মাসের মাথায় জামিন পান এপস্টেইন।
খোদ ট্রাম্পও এপস্টেইনের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে ঘোরাফেরা করতেন বলে জানা যায়। তবে প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আবারও গ্রেফতার করা হয় তাকে। সে সময়, ট্রাম্পের প্রতিজ্ঞা অনুসারে সেই মামলার নথিপত্রের একটি অংশ প্রকাশ করা হয় শুধু। তবে তাতে নতুন কোনো তথ্য ছিল না। এ জায়গাটি নিয়েই কথা বলছেন মাস্ক। মাস্কের পোস্টে উত্থাপিত দাবি মোতাবেক, অপ্রকাশিত নথিতে ট্রাম্পের নামও ছিল। পরে ২০১৯ সালে কারান্তরীণ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন এপস্টেইন।
ট্রাম্প প্রশাসনকে বড় বেকায়দায় ফেলতে নিজের স্ফীত ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো
হতে অর্থলগ্নির কথা বলছেন ইলন মাস্ক। এমনকি রিপাবলিকান বাজেটের পক্ষে ভোট
দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত করার হুমকিও দিচ্ছেন তিনি।
ট্রাম্পকে অভিশংসনের ভয় দেখানোর প্রসঙ্গ তো আছেই। এর সঙ্গে এপস্টেইন ফাইলে
নাম জড়ালে আরো বিপাকে পড়তে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে
মাস্ক পোস্টটি মুছে ফেললেও অভিযোগটি যদি সত্যি হয়, তবে নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবন আরেক দফা ধাক্কা খাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া বিষয়টি সত্য না হলেও রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেটিক শিবিরের ট্রাম্পবিরোধী অংশগুলোর জন্য রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পকে আক্রমণ করার নতুন রসদ হিসেবেই সেটি পরিগণিত হবে।
এদিকে, ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন ট্রাম্পও। তার মতে, মার্কিন বাজেটের অর্থ সাশ্রয়ের অন্যতম পন্থা হলো ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর শত শত কোটি ডলারের সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তিগুলো বাতিল করা। মূলত মাস্কের এ বিরুদ্ধাচারণকে জনকল্যাণমূলক বুলির আড়ালে মাস্কের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে সৃষ্ট এক বাধা হিসেবেই উল্লেখ করছেন তিনি।
কিন্তু সে যাই হোক, ট্রাম্প-মাস্কের এ প্রকাশ্য বাগযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সংকটে ট্রাম্পই যে বেশি বিপাকে পড়তে পারেন তা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। কেননা এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবেই সব ধরনের সম্পৃক্ততার পাঠ চুকিয়ে ফেলেছেন ইলন মাস্ক। নিজেই নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার কথাও বলছেন তিনি।
পাশাপাশি, ট্রাম্প প্রশাসনকে বড় বেকায়দায় ফেলতে নিজের স্ফীত ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো হতে অর্থলগ্নির কথা বলছেন ইলন মাস্ক। এমনকি রিপাবলিকান বাজেটের পক্ষে ভোট দেওয়া রাজনীতিবিদদের পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত করার হুমকিও দিচ্ছেন তিনি। ট্রাম্পকে অভিশংসনের ভয় দেখানোর প্রসঙ্গ তো আছেই। এর সঙ্গে এপস্টেইন ফাইলে নাম জড়ালে আরো বিপাকে পড়তে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
এর আগে, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি হতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক চলচ্চিত্র তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ দেওয়ার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া নিয়ে চাপের মধ্যে পড়েছিলেন ট্রাম্প। এর সঙ্গে এপস্টেইন ফাইলের বোঝা তার ঘাড়ে এলে ৭৮ বছর বয়সি এ মার্কিন রাজনীতিবিদ যে রাজনৈতিকভাবে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের কথা বলতে গেলে ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণের ফলে ইলন মাস্কের ব্যবসায় বড় অঙ্কের লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তার অঢেল পুঁজির কাছে সেটি তেমন কোনো বড় ফ্যাক্টর নয়। এটি তার দেওয়া হুমকিগুলোর মাধ্যমেই আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
লেখক : কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট