গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনৈতিক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এর মধ্যেই পাস হলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১২.৭০ শতাংশ। জিডিপির আকার বিবেচনায় এ বাজেট অত্যন্ত ছোট। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বাজেটে-জিডিপির অনুপাত ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ইন্ডিয়ার বাজেট তাদের জিডিপির ২৯ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৯ এবং নেপালের ২৩ শতাংশ। সুতরাং আমাদের বাজেট সেই তুলনায় আরো বড় হতে পারে। কিন্তু আয়ের উৎস, বিশেষ করে রাজস্ব আয় সীমিত হওয়ায়, আমাদের বাজেটে কাটছাঁট করেই চলতে হয়।
মুদ্রাস্ফীতি সমন্বয় করলেও প্রকৃত মূল্যে বেশ খানিকটা কমেছে বাজেটের আকার। তবে ঘাড়ের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসা মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য সংকোচনমূলক বাজেট প্রত্যাশিতই ছিল। উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে এবারের বাজেটের দুটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতির হার বর্তমান ৯.১৭ শতাংশ (এপ্রিল, ২৫) থেকে নামিয়ে ধার্যকৃত ৬.৫ শতাংশে নিয়ে আসা। আর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ৫.৫০ শতাংশ অর্জন করা।
এবারের বাজেটের একটি বড় চরিত্র হলো, এটি অতি মাত্রায় সংকোচনমূলক। দেশে
একইসঙ্গে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি চলমান রয়েছে। মূল
টার্গেট পয়েন্ট হলো মূল্যস্তর কমানো। শঙ্কার বিষয় হলো, অভ্যন্তরীণ
বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতার আভাস পাচ্ছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে
বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩.৯৬ শতাংশ থেকে কমে ২২.৪৮ শতাংশ হয়েছে। বেসরকারি খাতে
ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭.৫৭ শতাংশে।
তবে বাজেট বোঝার আগে দেশের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা বুঝে আসা দরকার। আমাদের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে মূলত তিনটি খাতের ওপর ভিত্তি করে। প্রথমত, পোশাকশিল্প, যার অবদান আমাদের মোট রফতানির মধ্যে ৮১ শতাংশ। শ্রমঘন এ শিল্পে কেবল প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ লাখের বেশি যার মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী। তা ছাড়া পোশাকশিল্পের কারণে যে ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠেছে অর্থনীতিতে তার অবদানও অনেক। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক রেমিট্যান্স।
বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখ লোক (২০২৩) দেশের বাইরে কর্মরত। বিগত ১১ মাসে এই খাতে মোট ৩২ বিলিয়ন ডলার দেশে এসেছে যা একটি রেকর্ড। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত এটি। তবে রফতানি আয় থেকে আমদানি বাবদ ডলার খরচ বাদ দিলে ফরেন রেমিট্যান্সই সর্বোচ্চ ডলার উপার্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত হবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মাটি। দেশের কৃষকেরা এ মাটি থেকে সোনা ফলায়। ১৮ কোটি মানুষের এ ছোট্ট দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। সম্প্রতি কৃষিতে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে এবং উৎপাদনশীলতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। যে কোনো সরকারকেই দেশের বাজেট বিনির্মাণে এ তিনটি খাতের কথা মাথায় রাখা দরকার।
পোশাকশিল্পের মূল সমস্যা দুটি। এ খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের সরবরাহ ঠিক রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও চোখে পড়ছে না। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ব্যাংক ঋণে সুদের হার চড়া। স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রাস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বহাল থাকবে এবং সুদের হার সহসা কমার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। তাই যারা ব্যাংক থেকে প্রকল্প ঋণ নিয়েছে বা চলতি মূলধন ঋণ নিয়ে ফ্যাক্টরি চালাচ্ছেন তাদের জন্য এটা একটা সমস্যা। শেষত, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে কৃষিতে ভর্তুকি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ালে তার রিটার্ন বহুগুণে আসবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ, সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি যন্ত্রপাতিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেওয়া বাজেটের একটা অপরিহার্য বিবেচনা থাকা উচিত।
আরেকটি জায়গায় আমাদের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার, সেটা হলো—সামাজিক নিরাপত্তা খাত। সমাজের একেবারে নীচু তলার মানুষের জীবনমান কিছুটা হলেও যাতে বাড়ে, তারা যেন বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারে সেদিকে সরকারের সুদৃষ্টি থাকা উচিত। যে দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষ আবার চরম দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সেই দেশের বাজেট হওয়া উচিত মানবিক বাজেট। আরেকটা বিষয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। দীর্ঘমেয়াদে একটি সুস্থ ও শিক্ষিত জাতি পেতে হলে এ দুই খাতে বরাদ্দ অন্তত তিনগুণ বাড়ানো উচিত। কেন যেন এদিকটাতে সরকারের নজর কম থাকে।
বাজেট বরাদ্দের চেয়ে বাজেট ব্যবস্থাপনার দিকটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাজেট ব্যবস্থাপনায় মূল চ্যালেঞ্জ তিনটি। প্রথমত রাজস্ব আহরণ, যা কোনো বছরই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না। ঘাটতি বাজেটে বছর শেষে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি আরো বেড়ে যায়। তা ছাড়া রাজস্ব আদায়ে দুর্নীতি বড় সমস্যা। আন্দোলন করে এনবিআরের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ জন্মলগ্ন থেকে এ সংস্থার বিশেষ কোনো সাফল্য-কথা নেই। ২ জুনের দৈনিক প্রথম আলোর একটা
খবরে দেখলাম—কোনো একটা কোম্পানির করের পরিমাণ ১০০ কোটা টাকা, দফারফা হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকায়, ম্যানেজ করতে গেছে ৬০ কোটি টাকা। ব্যবসায়ীর লাভ ৩০ কোটি, দেশের ক্ষতি ৯০ কোটি। এনবিআরকে ঢেলে সাজাতে না পারলে আয়-ব্যয়ের হিসাব কখনোই মেলানো যাবে না। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগ বাড়ানো। এক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বিনিয়োগ এলে রিজার্ভ বাড়ে, কর্মসংস্থান বাড়ে। কর্মসংস্থান বাড়লে মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তথা অবকাঠামো আমরা আজও তৈরি করতে পারিনি। বাজেটেও এর সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা নেই। তিন নম্বর বিষয়, বাজেট বাস্তবায়ন। প্রতিবছর উন্নয়ন বাজেটের (এ বছর—২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা) একটা বড় অংশ অবাস্তবায়িত থেকে যায়। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত টাকা আমরা খরচ করতে পারি না। আবার যেটুকু খরচ হয় তার একটা বড় অংশ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় নষ্ট হয়। অর্থাৎ টার্গেট গ্রুপের কাছে এর কিয়দংশ পৌঁছে মাত্র। তাই কেবল সংখ্যা দিয়ে নয় বাজেটের বাস্তবায়ন দিয়ে এর গুণগত বিচার করতে হবে।
আশার কথা হলো, বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি অনেকটাই স্থিতিশীল আছে। মুদ্রাস্ফীতি বেশি থাকলেও কমার প্রবণতায় রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে, উন্মুক্ত করার পরও, তেমন কোনো পতন ঘটেনি, বরং এক ধরনের স্থিতিশীলতা রয়েছে। এদিকে রিজার্ভ পরিস্থিতিও ততটা খারাপ নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এখন ধনাত্মক। আবার রফতানিতেও ভালো প্রবৃদ্ধি এসেছে (৯.৮৩ শতাংশ)। ফরেন রেমিট্যান্স প্রাপ্তি প্রতিমাসেই বাড়ছে (সার্বিক প্রবৃদ্ধি ২৮.৩৫ শতাংশ)। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বৈদেশিক খাতের অবস্থা ভালো। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে আমাদের অভ্যন্তরীণ খাতে, স্পষ্ট করে বললে অর্থবাজার বা মানি মার্কেটে। বিশেষত ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি যথেষ্ট নাজুক। খেলাপি ঋণ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে ২০.২০ শতাংশ। অনেক ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও হয়ত বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কোন উপায়ে এ খাতকে ঠিকঠাক করা সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে তাদের চেষ্টা রয়েছে একটা টেকসই সমাধানের জন্য।
কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার বিষয়ে আমার একটা কৌতূহল আছে। এটা অনেকটা বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো। ক্ষমতার বাইরে থাকলে এর সমালোচনা করে বাতিল চাওয়া হয়, কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে এটা কেউ বাদ দেয় না। বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এক সময় এর কড়া সমালোচক ছিলেন, কিন্তু তিনিও এই অনৈতিক কাজটি বাজেটে চালু রাখলেন। গত বিশ বছরের তথ্য ঘেটে দেখা গেছে এর থেকে খুব সামান্য সাফল্য পাওয়া গেছে। অথচ এর ফলে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। কিছু মানুষ দুর্নীতি তথা অর্থ কালো করার সুযোগ নিয়েছে নির্ভয়ে, বারবার।
এবারের বাজেটের একটি বড় চরিত্র হলো, এটি অতি মাত্রায় সংকোচনমূলক। দেশে একইসঙ্গে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি চলমান রয়েছে। মূল টার্গেট পয়েন্ট হলো মূল্যস্তর কমানো। শঙ্কার বিষয় হলো, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতার আভাস পাচ্ছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩.৯৬ শতাংশ থেকে কমে ২২.৪৮ শতাংশ হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭.৫৭ শতাংশে। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্থরতা আসবে। কর্মসংস্থান কমে গিয়ে সামগ্রিক চাহিদা কমে যেতে পারে। অর্থনীতি মন্দার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। তাই যেভাবেই হোক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে হবে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
কেকে/এএম