‘মোরা বন্ধন-হীন জন্ম-স্বাধীন, চিত্ত মুক্ত শতদল’ এ প্রতিপাদ্য ধারণ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দিনব্যাপী ১২৬তম নজরুল জয়ন্তী ২০২৫। এ আয়োজনে অন্যতম আকর্ষণ ছিল নজরুল পদক প্রদান পর্ব।
সোমবার (২৬ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গাহি সাম্যের গান’ মঞ্চে আয়োজিত আলোচনা সভা ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে নজরুল গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. রশিদুন নবী এবং নজরুল সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য শিল্পী মো. ইয়াকুব আলী খানকে ‘নজরুল পদক’ প্রদান করা হয়। তাদের হাতে পদক ও সনদ তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান এবং নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি. আর. আবরার। তিনি বলেন, ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নজরুলকে স্মরণ করছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় নজরুলের গান-কবিতা আমাদের তরুণদের এবং আমাদের সকলকে উদ্দীপ্ত করেছে। এই আয়োজনের মাধ্যমে আমরা নজরুলের প্রতি যে জাতীয় ঋণ, তার সামান্য প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। আমরা জাতি হিসেবে যেমন এক অস্থির সময় অতিক্রম করছি, তেমনি আমাদের সামনে বিরাট সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত হয়েছে। আমরা এক অপশক্তিকে পরাজিত করেছি। এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজ। তবে এ কাজ এককভাবে সরকারের নয়; জাতি হিসেবে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগেই এই কাজ সফল করতে হবে। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে আহ্বান জানাই এই সংস্কার কাজে এগিয়ে আসার জন্য।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাভাবিক শিক্ষা-পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখনও কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়মিত চালু করে অস্থিরতা দূর করতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।’
সভাপতির বক্তব্যে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিংশ শতকে যার কর্ম আমাদের আজও আলোড়িত করে, আগামী দিনেও তিনি আরো বলিষ্ঠভাবে আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকবেন। নজরুলের দর্শন উপেক্ষা করার নয়। তিনি সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্য, দলাদলি, ও অন্যায় দূর করতে চেয়েছিলেন। তার লেখনিতে যে সাহসিকতার প্রকাশ ঘটেছে, তা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি প্রেমের কবি, বিদ্রোহেরও কবি। তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্ম এই বাংলাদেশেই রচিত হয়েছিল। তিনি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ নয়, ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নজরুলের বিচরণ রয়েছে। তাঁর অবদান আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান। তাঁর চেতনা ধারণ করেই আমরা ১৯৭১-এ বিজয় অর্জন করেছি এবং আজকের যুব সমাজও সেই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করছে। নজরুলের আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যেন কোনো অশুভ শক্তি আবার মাথাচাড়া না দিতে পারে। ফ্যাসিস্ট সরকারকে যেভাবে সরিয়েছি, আগামী দিনে সেই হারমোনি রক্ষায়ও যুবসমাজকে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এম. জাকির হোসেন খান। স্বাগত বক্তব্য দেন ‘নজরুল পদক প্রদান উপ-কমিটি ২০২৫’-এর সদস্য-সচিব অধ্যাপক ড. মো. হাবিব-উল-মাওলা (মাওলা প্রিন্স)।
আলোচনা সভা ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইমদাদুল হুদা, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এ. এইচ. এম. কামাল, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত হোসেন সরকার, চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তপন কুমার সরকার, আইন অনুষদের ডিন মুহাম্মদ ইরফান আজিজ, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, প্রক্টর ড. মো. মাহবুবুর রহমান এবং ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক ড. মো. আশরাফুল আলম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রায়হানা আক্তার এবং মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. আব্দুল মোমেন।
এর আগে, সকাল থেকে পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের তৃতীয় তলার কনফারেন্স কক্ষে ‘আন্তর্জাতিক নজরুল বক্তৃতামালা ২০২৫’ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষক, গবেষক ও নজরুল অনুরাগীরা চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সন্ধ্যা সাতটায় ‘গাহি সাম্যের গান’ মঞ্চে আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীত ও নাটক ‘জিনের বাদশা’ পরিবেশিত হয়।
উল্লেখ্য, নজরুল জয়ন্তীর কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা সভা, বইমেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্যাম্পাস সজ্জা ও আলোকসজ্জাসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন। আয়োজনে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে উপাচার্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
কেকে/ এমএস