ইঞ্জিন হয়ত একটি বিমানের হৃদয়, কিন্তু সত্যিকারের আত্মা হলো পাইলট নিজেই—ওয়াল্টার র্যা লে
এ বিখ্যাত উক্তিটি যেন একেবারে মিলে যায় ক্যাপ্টেন শারহান আলীর জীবনের সঙ্গে। আকাশে ওড়ার স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা তার যাত্রা এখন পৌঁছেছে এক গৌরবময় শিখরে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর-এর অধিনায়ক হয়ে তিনি অর্জন করেছেন এক ঐতিহাসিক মাইলফলক—বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বয়সে এ মর্যাদাপূর্ণ পদের অধিকারী।
ক্যাপ্টেন শারহানের এ সাফল্য শুধু একজন পাইলটের ব্যক্তিগত অর্জন নয়; এটি বাংলাদেশের অ্যাভিয়েশন ইতিহাসে এক সাহসী অধ্যায়, যা উত্তরাধিকার, নিষ্ঠা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক অপূর্ব সমন্বয়ে নির্মিত।
১৯৮৬ সালের ২৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন শারহান আলী। তার ককপিটে পৌঁছানোর পথ তৈরি হয়েছে কঠোর অনুশীলন, হাজারো ঘণ্টার আকাশপথ পাড়ি এবং এক গর্বিত পারিবারিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে। তিনি একজন তৃতীয় প্রজন্মের পাইলট। দাদা ক্যাপ্টেন সিকান্দার আলী ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একজন ক্যাপ্টেন, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। তার বাবা ক্যাপ্টেন শোয়েব আলী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ৪০ বছরেরও বেশি সময় সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ সেই ধারাবাহিকতায় ক্যাপ্টেন শারহান আকাশ ছুঁয়ে চলেছেন নিজের পথ।
আকাশে ওড়ার গল্পের সূচনা
শারহান আলীর পাইলট হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব থেকে। সেখানেই তিনি সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের অধীনে CPL ও IR লাইসেন্স অর্জন করেন। এখন পর্যন্ত তার অভিজ্ঞতার ঘড়িতে যুক্ত হয়েছে ৯,৩০০ ঘণ্টারও বেশি উড়োজাহাজ চালনার অভিজ্ঞতা। তিনি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন চীনের MA60, ATR 72, Airbus A310, Boeing 737 এবং 777 এর মতো আধুনিক বিমান।
২০০৮ সালে একটি প্রাইভেট এয়ারলাইন্সে শুরু হয় তার পেশাগত উড়ান। আর মাত্র ২৪ বছর বয়সে, মাত্র ৫০০ ঘণ্টার ফ্লাইট অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যোগ দেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। এখান থেকেই শুরু হয় তার এক অনন্য উত্থান।
শারহানের ক্যারিয়ারে এসেছে নানা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু প্রতিটি চ্যালেঞ্জই তিনি রূপান্তর করেছেন একেকটি অর্জনে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। বৈশ্বিক মহামারির কারণে এই পদোন্নতি কিছুটা বিলম্বিত হলেও তার দক্ষতা কখনো থেমে থাকেনি।
৩৮ বছর বয়সে তিনি বোয়িং ৭৭৭–৩০০ইআর-এর ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী এই পদের অধিকারী।
তার ক্যারিয়ারের প্রতিটি অধ্যায়েই রয়েছে অনুপ্রেরণার গল্প। যেমন : বোয়িং ৭৭৭-এ ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা, ভিয়েতনাম থেকে মিশর পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার ফেরি ফ্লাইট সফলভাবে সম্পন্ন করা, ‘সিত্রাং’ ও ‘রেমাল’-এর মতো ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও সাহসিকতার সঙ্গে উড়োজাহাজ পরিচালনা। প্রতিটি ফ্লাইটে দেখা মেলে তার শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব ও চূড়ান্ত দক্ষতার।
ক্যাপ্টেন শারহানের সাফল্য এদেশের তরুণদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার গল্প বলে—স্বপ্ন দেখো বড় করে, পরিশ্রম করো নিষ্ঠার সঙ্গে, সুযোগ আসলে আত্মবিশ্বাসের ডানায় ভর করে আকাশ ছুঁয়ে ফেলো। তিনি প্রমাণ করেছেন, আকাশ আর সীমা নয়—এটি কেবল শুরু।
আজ যখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই ঐতিহাসিক সাফল্য উদযাপন করছে, তখন একযোগে তারা ভবিষ্যতের জন্য তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে—একটি বাংলাদেশ, যা গড়ে উঠবে উৎকর্ষ, আধুনিকতা এবং উদ্ভাবনের ওপর।
কেকে/এএম