সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫,
২৮ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      
বিবিধ
বাংলাদেশে যত ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা
বিবিধ ডেস্ক
প্রকাশ: রোববার, ২৭ জুলাই, ২০২৫, ৮:৪৫ পিএম

বাংলাদেশের আকাশপথের ইতিহাসে কয়েকটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর শোক ও আতঙ্কের স্মৃতি হয়ে রয়েছে। দেশি-বিদেশি যাত্রীবাহী কিংবা সামরিক বিমান, বিভিন্ন সময়ে যান্ত্রিক ত্রুটি, খারাপ আবহাওয়া, অথবা পাইলটের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষ করে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা বা আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী বিমানের ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো জাতীয়ভাবে আলোচিত ও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ ও স্মরণযোগ্য কিছু বিমান দুর্ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিয়ে আজকের আয়োজন

২০২৫ সালের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত

২০২৫ সালের ২১ জুলাই, দুপুরে রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ী এলাকায় মাইলস্টোন ক্যাম্পাস এক ভয়াবহ দৃশ্যের সাক্ষী হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে স্কুল ভবনে। আগুনের ফুলকি, বিকট শব্দ, আর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কে পুরো এলাকা স্তব্ধ হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক। নিহত হয়েছেন বিমানের পাইলটও।

বিমানটি দুপুর ১:০৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীর উত্তম একে খন্দকার থেকে উড্ডয়ন করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম (সাগর) তার প্রথম একক মিশনে ছিলেন। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং স্টল করে। তিনি আর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে পারেননি। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে তাকে ইজেক্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নিম্ন উচ্চতার কারণে ইজেকশন সম্ভব ছিল না। তিনি দিয়াবাড়ির মতো একটি খোলা স্থানের দিকে বিমানটি নিয়ে গিয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হননি।

দুপুর ১টার দিকে, বিমানটি প্রথমে কলেজের সাততলা ব্লক-৭ এর ছাদে ধাক্কা মারে এবং এরপর সরাসরি দুই তলা হায়দার আলী ভবনে আছড়ে পড়ে। বিমানটি ভবনের মূল ফটকে আঘাত করে নিচতলার সিঁড়ির কাছে এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, যার ফলে একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়।

দুর্ঘটনার পর পাইলট তৌকির ইসলাম জীবিত ছিলেন এবং তাকে মিল মি-১৭ভি-৫ হেলিকপ্টারে করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়, তবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান। নয়টি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট ও ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। নিরাপত্তা ও উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দুই প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেট্রোরেলের একটি কোচ সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। 

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দুই আসনবিশিষ্ট একটি স্বল্প-পাল্লার ও এক ইঞ্জিনচালিত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান এফ-৭ বিজিআই। মূলত মূল সংস্করণ এফ-৭ এর জন্য পাইলটদের প্রস্তুত করতে এফ-৭ বিজিআই বিমানটি ব্যবহৃত হয়। এটি বিশেষভাবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চাহিদা পূরণের জন্য চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। ২০১১ সালে প্রথম এ সংস্করণের বিমান কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে এই সংস্করণের ৩৬টি বিমান চীন থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ।

২০১৮ সালে ইউএস-বাংলা বিমান দুর্ঘটনা 

২০১৮ সালের ১২ মার্চ, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (টিআইএ) বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের বিমান চলাচল ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

ফ্লাইট বিএস-২১১ (বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ মডেলের বিমান) ঢাকা থেকে ৬৭ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু নিয়ে নেপালের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেছিল। কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিমানটি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে এবং বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়, সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। এ দুর্ঘটনায় মোট ৫১ জন আরোহী (যাত্রী ও ক্রু) প্রাণ হারান, যাদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি এবং ২২ জন নেপালি ছিলেন। ১৭ জন যাত্রীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল।

দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে নেপাল এবং ইউএস-বাংলা উভয়পক্ষ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন দাবি করা হয়। নেপালি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, বিমানটি কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশনা অনুসরণ করেনি। অন্যদিকে, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স জানায়, কাঠমান্ডু বিমান কর্তৃপক্ষের কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া নির্দেশনায় বিভ্রান্ত হয়েই পাইলট ভুল রানওয়েতে নেমেছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনে এটিসি এবং পাইলটের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সমন্বয়হীনতা একটি প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবেও পরিচিত।

কানাডার কোম্পানি বোম্বারডিয়ারের তৈরি ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি ২০১৪ সালে ইউএস-বাংলার বহরে যুক্ত হয়। উড়োজাহাজটি ঠিক ছিল বলেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল বলে জানান সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান। উড্ডয়নের দিনও উড়োজাহাজটিতে কোনো সমস্যা পায়নি সিভিল এভিয়েশন। 

২০১৫ সালের কক্সবাজার কার্গো বিমান বিধ্বস্ত 

২০১৫ সালের ৯ মার্চ, কক্সবাজারে একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। একটি কার্গো বিমান উড্ডয়নের মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় পাইলটসহ তিনজন নিহত হন। 

দুর্ঘটনার শিকার বিমানটি ছিল একটি অ্যান্টোনভ এন-২৬ মডেলের কার্গো বিমান, যা রাশিয়ান এন-২৬ বিমান। এটি সকালে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। বিমানটিতে মূলত মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পণ্য পরিবহনের কথা ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উড্ডয়নের পরপরই বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। টেক-অফের প্রায় পাঁচ মিনিটের মাথায় বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের কাছে আছড়ে পড়ে। বিমানটি সাগরে পতিত হওয়ার পরপরই দু’টুকরা হয়ে যায় এবং এর কিছু অংশ সাগরের পানিতে ডুবে যায়।

দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার কাজে অংশ নেন। প্রথমে বিমানটির ধ্বংসাবশেষ এবং পরে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিমানের পাইলট, কো-পাইলট এবং একজন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। এ দুর্ঘটনায় বিমানের সব আরোহীর মৃত্যু হয়।

প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হয়, বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটিই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ছিল। রাশিয়ান নির্মিত অ্যান্টোনভ এন-২৬ মডেলের বিমানগুলো সাধারণত পুরোনো প্রযুক্তির হয় এবং এগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থাকে। এ দুর্ঘটনাটি বাণিজ্যিক কার্গো ফ্লাইটের নিরাপত্তা এবং পুরোনো বিমানের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

২০১৫ সালের সিলেট বিমান দুর্ঘটনা 

২০১৫ সালের আগস্টে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে দুর্ঘটনা ঘটে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কারণ এতে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।

সেদিন সকালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-৫২ দুবাই থেকে ২২০ জন যাত্রী নিয়ে সরাসরি সিলেট আসছিল। সকাল ৭টার দিকে বিমানটি যখন সিলেট বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবতরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই একটি পাখি বিমানের ডানদিকের ইঞ্জিনের ভেতর ঢুকে পড়ে। এই আকস্মিক ঘটনার ফলে ইঞ্জিনের চারটি ব্লেড ভেঙে যায় এবং ইঞ্জিনটি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়ে।

পাখির আঘাতে ইঞ্জিনের মারাত্মক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও, বিমানটির পাইলট ও ক্রুদের তাৎক্ষণিক এবং দক্ষ পদক্ষেপের কারণে একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়। বিমানটি নিরাপদে রানওয়েতে অবতরণ করতে সক্ষম হয় এবং কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ২২০ জন যাত্রীর সবাই অক্ষত ছিলেন, যা ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা।

বিমান চালনার ক্ষেত্রে পাখির আঘাত একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক ঘটনা। উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় পাখির সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষ হলে তা বিমানের ইঞ্জিন, উইন্ডশিল্ড বা অন্যান্য অংশে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এ ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য বিমানবন্দরগুলোতে পাখি তাড়ানোর বিভিন্ন ব্যবস্থা (যেমন : শব্দযন্ত্র, ফায়ার ক্র্যাকার, বা প্রশিক্ষিত বাজপাখি) ব্যবহার করা হয়। সিলেট বিমানবন্দরের এ ঘটনাটি পাখির আঘাতের বিপদ এবং এক্ষেত্রে দক্ষ পাইলটদের ভূমিকার গুরুত্ব আবারও প্রমাণ করে।

২০০৪ সালের সিলেট বিমান দুর্ঘটনা

২০০৪ সালের ৮ অক্টোবর, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আবারো একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, যা ছিল ১৯৯৭ সালে একই মডেলের বিমানের দুর্ঘটনারই এক পুনরাবৃত্তি। সেদিন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিজি-৬০১ ঢাকা থেকে ৭৯ জন যাত্রী এবং ৪ জন ক্রু নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।

বিমানটি ছিল ফকার এফ২৮-৪০০০ মডেলের, যা ১৯৯৭ সালের দুর্ঘটনার কবলে পড়া বিমানের মডেলেরই অনুরূপ। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে ছিল ভেজা ও পিচ্ছিল। এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিমানটি রানওয়েতে সফলভাবে নামতে পারলেও, ভেজা রানওয়ের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত ছিটকে গিয়ে রানওয়ের পাশের একটি খাদে পড়ে যায়।

এ দুর্ঘটনায় বিমানটির সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সৌভাগ্যবশত কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। ৭৯ জন যাত্রী ও ৪ জন ক্রূর মধ্যে মাত্র ২ জন যাত্রী সামান্য আহত হন। এটি ছিল একটি বড় স্বস্তির বিষয়, কারণ এর আগেও এই মডেলের বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল।

ফকার এফ২৮-৪০০০ মডেলের বিমানটি স্বল্প পাল্লার ফ্লাইটের জন্য নকশা করা হয়েছিল এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তাদের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রুটে এটি ব্যবহার করত। এ মডেলের বিমানের বারবার দুর্ঘটনায় পড়া (১৯৯৭ এবং ২০০৪ সালে সিলেটে) বিমান নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। তবে, উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল, যা সম্ভবত বিমানের গঠনগত সুরক্ষা এবং জরুরি অবতরণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা প্রমাণ করে।

এ দুর্ঘটনাগুলো বাংলাদেশের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে রানওয়ের নিরাপত্তা, বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিমানের অবতরণ প্রক্রিয়া এবং বিমান বহরের রক্ষণাবেক্ষণে আরো নজর দিতে উৎসাহিত করেছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যায়।

১৯৯৭ সালের সিলেট দুর্ঘটনা

১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফকার এফ২৮-৪০০০ মডেলের বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়। এটি ছিল ফ্লাইট বিজি-৬০৯, যা ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে ৮৫ জন যাত্রী নিয়ে উড্ডয়ন করেছিল।

বিমানটি যখন সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টা করছিল, তখন ঘন কুয়াশার কারণে দৃশ্যমানতা অত্যন্ত কম ছিল। এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিমানটি রানওয়ে থেকে প্রায় ৫ থেকে ৫.৫ কিলোমিটার দূরে উমাইরগাঁও নামক স্থানের একটি ধানখেতে বিধ্বস্ত হয়।

যদিও বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গিয়েছিল, তবে আশ্চর্যজনকভাবে এই দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হননি। বিমানে থাকা ৮৫ জন যাত্রীর মধ্যে ১৭ জন আহত হন। এটি ছিল একটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়, কারণ সাধারণত এ ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ফকার এফ২৮ ফ্রেন্ডশিপ হলো একটি ডাচ কোম্পানি ফকার দ্বারা নির্মিত ছোট থেকে মাঝারি পাল্লার জেট এয়ারলাইনার। এটি সাধারণত স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইটের জন্য ব্যবহৃত হতো। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তাদের অভ্যন্তরীণ এবং আঞ্চলিক রুটে এই মডেলের বিমান ব্যবহার করত। 

১৯৮৪ সালের ভয়াবহ দুর্ঘটনা

১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখটি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত। সেদিন চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে ঢাকার তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) অভ্যন্তরীণ যাত্রী ফ্লাইট পরিচালনা করছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ প্লেনটি।

দুর্ঘটনার দিন ঢাকার আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। উদ্দাম ও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দৃষ্টিসীমা ছিল খুবই সীমিত। এ অবস্থার মধ্যে বিমানটিকে বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে অবতরণ করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাইলট প্রথমে ৩২ নং রানওয়েতে অবতরণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রানওয়ে দেখা না যাওয়ায় এবং শেষ মুহূর্তে পাইলট বুঝতে পারেন যে তিনি ভুল দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, তাই তিনি অবতরণ না করে আবার উড়ে যান।

দ্বিতীয় দফায়, বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতেমা রোকসানা (যিনি এই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন) আইএলএস (Instrument Landing System) ব্যবহার করে অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে তাকে রানওয়ে ১৪-তে অবতরণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভারী বর্ষণের মধ্যে প্রবল ঝোড়ো বাতাসে আবার অবতরণের চেষ্টা চালালে পার্শ্বমুখী বাতাসের ঝাপটার কারণে অবতরণ আবারো ব্যর্থ হয়।

তৃতীয়বার অবতরণ করার সময় (রানওয়ে ১৪-তে দ্বিতীয়বার) বিমানটি রানওয়ে থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়কের কাছে একটি জলাভূমিতে পতিত হয়ে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় ৪ জন ক্রু ও ৪৫ জন যাত্রীসহ মোট ৪৯ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। যাত্রীদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ, একজন জাপানি এবং ৩৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন, যাদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য একটি সংযোগ ফ্লাইট ধরার উদ্দেশে ঢাকা ভ্রমণ করছিলেন। এটি বাংলাদেশের মাটিতে ঘটা সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী বেসামরিক বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

S2-ABJ হিসেবে নিবন্ধিত ফকার এফ২৭-৬০০ নামের উড়োজাহাজটি ১৯৭১ সালে তৈরি করা হয়েছিল। এটি প্রথমে ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য চালনা করা হয় কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর ভারত সরকার থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া সহযোগিতার একটি অংশ হিসাবে, এটি ১৯৭২ সালে বিমানকে দেওয়া হয়। দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত, উড়োজাহাজটি মোট ২৪,০৮৫ চক্র এবং মোট ১৫,৫৯৫ এয়ারফ্রেম ঘণ্টা উড়েছিল।

বাংলাদেশে প্রথম বিমান দুর্ঘটনাসহ আরো কয়েকটি

বাংলাদেশে প্রথম বিমান দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন ম্যাগডোনালস ডগলাস কোম্পানির তৈরি ডিসি-৩ এয়ারক্রাফটটি বিধ্বস্ত হয়, যাতে পাঁচজন ক্রু নিহত হন। এর ঠিক চার বছর পর, ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো দেশে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খাদেমুল বাশার এবং স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হক নিহত হন, যা জাতীয়ভাবে গভীর শোকের বিষয় হয়ে ওঠে। 

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৫ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়, এতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কুদ্দুস নিহত হন। এরপর ১৯৯৬ সালে একই বাহিনীর দুটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় উইং কমান্ডার হক, স্কোয়াড্রন লিডার ইসলাম এবং ফ্লাইং অফিসার মাসুদ প্রাণ হারান।

১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার পোস্তগোলায় এয়ার পারাবতের একটি প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়নের সময় আগুন ধরে বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রাণ হারান পাইলট ফারিয়া লারা, যিনি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের মেয়ে, এবং কো-পাইলট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিমান বাহিনীর একটি মিগ-২১ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এক পাইলট নিহত হন।

২০০২ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমান ঘাঁটির কাছে একটি এম-১ হেলিকপ্টার টেলিভিশন টাওয়ারে ধাক্কা লেগে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় উইং কমান্ডার কাজী কামরুল নেওয়াজ, ফ্লাইং অফিসার সাব্বির আহমেদ, ওয়ারেন্ট অফিসার জহির হোসেন এবং সার্জেন্ট আবদুস সামাদ প্রাণ হারান।

২০০৮ সালের ৮ এপ্রিল টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়িপাড়া গ্রামে বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ হাসান প্যারাস্যুটে অবতরণ করার চেষ্টা করলেও আহত অবস্থায় পরে মারা যান।

২০০৯ সালের ৯ মার্চ যশোর থেকে ঢাকায় আসার পথে একটি সামরিক হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম এবং পাইলট লে. কর্নেল শাহীদ ইসলাম নিহত হন। এরপর ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর একটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুজন স্কোয়াড্রন লিডার প্রাণ হারান।

২০১৩ সালের জুলাই মাসে রাশিয়ার তৈরি একটি এ-ফাইভ যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার একটি বিলে পড়ে যায়। তবে পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবু জাহের আরাফাত প্যারাস্যুটে অবতরণ করে প্রাণে রক্ষা পান।

২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যশোর সদর উপজেলার মাহিদিয়া গ্রামের ধানখেতে বিমান বাহিনীর একটি পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ওই দুর্ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার ফারুক এবং পাইলট অফিসার জামি দুজনই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হন।

এসব দুর্ঘটনা বাংলাদেশের বিমান চলাচল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একাধিক প্রশ্ন তুলেছে এবং প্রতিটি ঘটনা একটি সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য নিরাপত্তা ও কারিগরি প্রস্তুতির গুরুত্ব তুলে ধরে।
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাক ভাড়া করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত তারা
শিশু বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার
১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ

সর্বাধিক পঠিত

আসছে নাটক ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’
চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
পাল্লা বাজারে রক্তলাল শাপলার মনভোলানো সমাহার
কালাইয়ে বিএনপির গণমিছিল ও লিফলেট বিতরণ
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close