স্বামীর হাত ধরেই মূলত চা-গাছের সঙ্গে পরিচয় তার। ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কুমিল্লা থেকে স্বামী আবদুল বারেকের সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানে। সেখানে সংসার শুরুর পরপরই স্বামীর সঙ্গে লেগে পড়েন চা বাগানের কাজে। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকদের মতো জেসমিনও ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন একজন চা-শ্রমিক।
এভাবেই চা-পাতার সাথে শুরু হয় তার মিতালী। যা জীবন সংগ্রাম চলছে প্রায় চার যুগ ধরে। একটি-দুটি পাতা উত্তোলন করতে করতে এখন হয়ে গেছেন দেশসেরা। টানা দ্বিতীয় বারের মতো পেলেন পাতা উত্তোলন কারী (চয়নকারী) হিসেবে পুরস্কার। সারাদেশে সর্বোচ্চ চা পাতা চয়নকারী শ্রমিক হিসেবে জেসমিন আক্তার বাংলাদেশ চা বোর্ডের এই পুরস্কার পেয়েছেন।
বুধবার (২১ মে) ঢাকায় জাতীয় চা দিবসের অনুষ্ঠানে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। টানা দু'বার শ্রেষ্ঠ চা পাতা চয়নকারী হওয়ায় অতিথি পর্যায়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ পায় জেসমিন আক্তার। তুলে ধরেন চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া।
দেশসেরা হওয়ার পেছনের গল্প জানতে মঙ্গলবার গিয়েছিলাম জেসমিনের কর্মস্থল ফটিকছড়ি উপজেলার নারায়ণহাট ইউনিয়নে অবস্থিত ইস্পাহানী গ্রুপের মালিকানাধীন নেপচুন চা-বাগানে। চা বাগানে গিয়ে দেখা মেলে তার। কথা হয় জেসমিনের সাথে। তার চা-পাতা উত্তোলনের মাঝে রয়েছেন এক ধরনের ছন্দ। কাজের ফাঁকেই কথা হয়। সেরা হওয়ার পেছনে কী জাদু- এমন প্রশ্ন করলে জেসমিন বলেন, ‘বেশি পাতা উত্তোলনের জন্য বিশেষ কোনো জাদু নেই’। তিনি বলেন, ১৬ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে কুমিল্লা থেকে স্বামী আবদুল বারেকের সঙ্গে চলে আসেন ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানে। সেখানে সংসার শুরুর পরপরই স্বামীর সঙ্গে লেগে পড়েন চা বাগানের কাজে। ৪২ বছর ধরে সেই কাজই করে চলেছেন তিনি। স্বামীর সাথে তার জীবন সংগ্রাম শুরু তাই সব সময় চা-পাতা নিয়েই ভাবনা তার। কীভাবে দুটো পয়সা বেশি পাবেন, সেই চিন্তা থেকে চেষ্টা করেন অন্যদের চেয়ে একটু বেশি চা-পাতা উত্তোলনের। এ জন্য তার চিন্তা চেতনা-ধ্যান সব কিছু চা-পাতাকেন্দ্রিক। একাগ্রতা আর চা-পাতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তিনি পৌঁছে গেছেন সর্বোচ্চ স্থানে। তিনি বলেন, আজ দেশসেরা হতে পেরে সত্যি আনন্দিত। পুত্র-কন্যা ও স্বামীসহ সংসারের ৮ সদস্য এই বাগানে কর্মরত। এতে আমি গর্বিত। তার এ অর্জনে খুশি বাগানের অন্য শ্রমিকরাও।
তিনি আরো বলেন, গত বছর (২০২৪ সালে) আমি ৩৪ হাজার ৯৩৭ কেজি চা পাতা উত্তোলন করতে সক্ষম হই। যার কারণে আমি আবারও সেরা চা পাতা উত্তোলনকারী (চয়নকারী) হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছি।
টানা দ্বিতীয় বারের মতো দেশসেরা হওয়া ও কাজের স্বীকৃতি পাওয়ায় বেশ উচ্ছ্বসিত জেসমিন আক্তার। তিনি বলেন, আমি খুব আনন্দিত। পরিবারের সবাই আনন্দিত। গত ২ বছর আগে আমাদের বাগানের আরেক শ্রমিক উপলক্ষী সেরা হয়ে পুরস্কার জিতেছিল। এবারের মতো দ্বিতীয়বার আমি পেলাম। বিশেষ করে সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের মতো ক্ষুদ্র শ্রমিকদের কাজের মূল্যায়ন করার জন্য।
তার স্বামী বারেক পাতা সংগ্রহকারী না হলেও বাগানে অন্য কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাদের দুই ছেলে, দুই পুত্রবধূ, মেয়ে ও মেয়ে জামাইও চা বাগানে কাজ করেন। পরিবারের আট সদস্য চা শিল্পের সাথে জড়িত উল্লেখ করে জেসমিন আকতার আরো বলেন, নাতি-নাতনীদেরকে আমাদের মতো শ্রমিক পেশায় নিতে চাইনা। তাদেরকে লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই।
পরপর দু'বার তার এ সাফল্যে খুশি বাগানের অন্যান্য শ্রমিকরাও। তারা জানান, আমাদের বাগান থেকে প্রথমে উপলক্ষ্মী ত্রিপুরা এর পর টানা দু'বার জেসমিন চা-পাতা তুলে দেশসেরার পুরস্কার পেয়েছে। এ জন্য আমরা অনেক খুশি! আমরা গর্বিত। আমরা চাই সে আরো সফল হোক। এ ছাড়া চা-শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা, বাণিজ্য উপদেষ্টাসহ চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান নেপচুনের চা শ্রমিকরা।
এম এম ইস্পাহানি গ্রুপের নেপচুন চা বাগানের ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘দেশের ১৬৮টি চা-বাগানের মধ্যে নেপচুন চা-বাগান থেকে টানা তিন বার দেশসেরা চা-শ্রমিক বা পাতা চয়নকারী নির্বাচিত হওয়ায় আমরা আনন্দিত। টানা দ্বিতীয়বারের মতো জেসমিন আক্তার সেরা হয়েছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা চাই জেসমিনের মতো অন্য শ্রমিকরাও সেরা হোক।’ তিনি জানান, সম্প্রতি তিনটি চা-বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে ওপেন চা পাতা উত্তোলন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। হালদাভ্যালী চা-বাগানে অনুষ্ঠিত ওই প্রতিযোগিতায় ৩০ মিনিটে ১৩ কেজি চা পাতা চয়ন (উত্তোলন) করে জেসমিন আক্তার প্রথম হওয়ার গৌরব চূড়ান্তভাবে ধরে রাখেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় ২ হাজার ৭০০ একর আয়তন বিশিষ্ট পাহাড়-সমতল এলাকায় গড়ে উঠে ইস্পাহানি গ্রুপের নেপচুন চা বাগান। ২০০৯ সালে বৃক্ষরোপণে দেশসেরা চা বাগান মনোনীত হয় বাগানটি। ২০২০ সালে গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড মনোনীতও হয় এ বাগান। দীর্ঘ ৬৫ বছরে এ বাগান নানা সফলতার পাশাপাশি চা উৎপাদনেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ২০২৩ সালের চা পাতা চয়নে দেশসেরা চা বাগান শ্রমিক হয়েছিলেন উপলক্ষী ত্রিপুরা। গত বছর মতো এবার বছরও চা পাতা চয়নে দেশসেরা হয়েছেন একই বাগানের জেসমিন আক্তার।
কেকে/এআর