সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান ও মাহবুবুর রহমানের আমলে টার্মিনালের জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জায়গা টার্মিনালের হলেও বাস রাখার জায়গা না রেখে সেখানে দোকান বরাদ্দ দিয়ে কোটি টাকা নিজের পকেটে নিয়েছে সাবেক দুই পৌর মেয়র যার কারণে টার্মিনালে জায়গা সংকটের কারণে এখন বাস দাঁড়াতে পারছে না। এভাবে নানা অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে অকেজো হয়ে পড়ে আছে কক্সবাজার বাস টার্মিনাল। বাস টার্মিনাল থেকে বাস না ছেড়ে সড়কের বাস কাউন্টার করে সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করার কারণে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বাস টার্মিনাল গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। অনিয়ম-দুর্নীতির আঁতুড়ঘর কক্সবাজার বাস টার্মিনাল। ২০০১ সালে উদ্বোধন হওয়া কক্সবাজার বাস টার্মিনালে এক সময় প্রায় ৩০০ বাস রাখার জায়গা থাকলেও বর্তমানে ৬০টির বেশি বাস রাখার স্থান নেই। গত ২৩ বছর নতুন করে বসানো হয়েছে কয়েকশ দোকান ও টিকিট কাউন্টার। এসব দোকান বাণিজ্যে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতিতে ছিল কক্সবাজার পৌরসভা। এই বাস টার্মিনালে বাস যাত্রীদের জন্য মসজিদ, রেস্তোরাঁ, শ্রমিকদের জন্য অফিস ওপরে আর নিচে পাবলিক টয়লেট, পুলিশ বক্স, মেয়র অফিস, যাত্রীদের বসার জায়গাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত করছে একটি সিন্ডিকেট।
দূরপাল্লা ও কক্সবাজারের আশপাশের বিভিন্ন রুটের বাসের যাত্রী ওঠানামার জন্য এই টার্মিনাল ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টার্মিনালে এখন গাড়ি থাকে হাতেগোনা। চালকদের টার্মিনাল ব্যবহারের আগ্রহ নেই। সড়কের পাশে কাউন্টার করে এবং সড়কে ওপর গাড়ি পার্কিং করেই যাত্রী ওঠানামা করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে যানজট। টার্মিনালটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা থাকলেও বিকাল ৫টার পরে বন্ধ হয়ে যায় বলে জানা গেছে। টার্মিনালের সামনে গড়ে উঠেছে একাধিক বহুতল অবৈধ দোকানপাট; যেখানে চলে অবৈধ মাদক ব্যবসা। অবৈধ দোকানের কারণে টার্মিনালে পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় বাসগুলো টার্মিনালের বাইরে পার্কিং করা হয়। এর ফলে এলাকায় যানজট বাড়ছে। শহরের কলাতলী, লিংকরোড় ও টার্মিনালের বাইরে দূরপাল্লার বাসের অবৈধ কাউন্টারের কারণে টার্মিনালটি এখন অকেজো হয়ে পড়েছে এবং সেখানে একটি সিন্টিকেট বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, বর্তমানেও বেশ কয়েকটি দোকান বাণিজ্যে জড়িত। তাই তাদের দোসরসহ সবার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। কক্সবাজার বাস টার্মিনালে ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, এক সময় বাস টার্মিনালে অনেক জায়গা ছিল। তখন ২৫০ থেকে ৩০০টি বাস রাখার স্থান ছিল। বর্তমানে সর্বোচ্চ ৬০টির বেশি বাস রাখার জায়গা নেই। বেশিরভাগ দোকান এবং কাউন্টারের মাধ্যমে দখল করা হয়েছে। আর এই দখলের মূল কারিগর হচ্ছেন সাবেক দুই মেয়র। তবে তাদের দোসর হিসেবে এই দুর্নীতিতে কাজ করেছে বাস টার্মিনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুপারভাইজার আনচার উল্লাহ। তারা এখানে অন্তত ১০টি দোকানের মালিক বলে জানা গেছে যা পরবর্তীতে বিক্রি করে দেয় বলে জানা গেছে। শুরুতে শিপক কান্তি পাল থাকার কারণে সেও বেশ কয়েকটি দোকান দখলে নিয়ে পরে বিক্রি করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। আবার এখানে কোনো দোকান হস্তান্তর বা বেচাকেনা হলে সেখানেও তারা কমিশন পান এমনটা জানা গেছে ।
এদিকে বাস টার্মিনালের সুপারভাইজার আনছার উল্লাহর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সুপারভাইজার শুধু আমি একজন নই। আমি ছাড়া আরো ৩ জন সুপারভাইজার রয়েছে। তারা হলেন মিটন কান্তি দাশ, নুর মোহাম্মদ ও নুরুল হক। বিশেষ করে নুরুল হক সামগ্রিক বিষয়গুলো দেখেন বলে জানান আনছার উল্লাহ। তিনি আরো বলেন, সুন্দর একটি বাস টার্মিনাল অকেজো হয়ে যাচ্ছে তা আমাদেরও খারাপ লাগছে। টার্মিনালের জায়গা দখল করে যেসব দোকান করা হয়েছে তা সাবেক দুই মেয়রের মাধ্যমে হয়েছে আর তার মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যার কারণে বাস টার্মিনাল ছোট হয়ে গেছে এবং বাস দাঁড়াতে অসুবিধা হয়।
কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন জানান, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ভ্রমণপিপাসু মানুষের প্রধান আকর্ষণ। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত লাখো পর্যটকের পদভারে মুখরিত থাকে এ শহরটি। বছরের অন্যান্য সময় ও পর্যটক থাকে কমবেশি। পর্যটকদের সুবিধার্থে সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক হোটেল মোটেল জোন, টুরিস্ট পুলিশ, পর্যটন সেল, মেরিন ড্রাইভ রোড়, আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর ও বিভিন্ন বিনোদনমূলক ব্যবস্থা। সব বিষয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সম্পূর্ণ হ-য-ব-র-ল অবস্থায় রয়েছে পরিবহনের জন্য নির্দিষ্ট কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের। কক্সবাজারের এ সুন্দর বাস টার্মিনালটি এখন অবৈধ দখলে যাওয়ার কারণে আগের মতো বাস দাঁড়ানোর সুযোগ না থাকার কারণে বাস কাউন্টার চলে এসেছে সড়কের পাশে। যার কারণে এখন যানজট লেগেই থাকে নিয়মিত।
এদিকে শহরের লালদীঘির পাড় থেকে শুরু করে কলাতলী হয়ে লিংকরোড় পর্যন্ত ১০ ফিট অন্তর বাস কাউন্টার করার কারণে সড়কে বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানাম করে আসছে এমনটা নজরে এসেছে। অন্যদিকে কক্সবাজার শহরে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে বাস টার্মিনাল থাকলেও সেখান থেকে কোনো ধরনের বাস ছাড়া হয় না। অকেজো করে রাখা হয়েছে টার্মিনালকে। যার পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সড়ক ব্যবস্থাপনার দৈন্যদশায় পরিণত হয়েছে। যদিও এ নিয়ে পরিবহন চালকদের রয়েছে নানা অজুহাত। পুলিশ বলছে, সড়কে পরিবহনে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এদিকে পথচারীরা বলছেন, প্রশাসনের খামখেয়ালি ও উদাসীনতার কারণে সড়কের ব্যবস্থাপনার এ দৈন্যদশা।
ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষরা বলেন, টার্মিনাল ব্যবহার না করে সড়কের পাশে বাস কাউন্টার করার কারণে পর্যটন শহরে যানজট বেড়েছে। সড়কে অবৈধভাবে অনেক গাড়ি পার্কিং করা হয়। এর কারনে এখানে যানজট লেগেই থাকে। আমরা হাটতে গেলেও কষ্ট হয়। অনেকেই বলেন এটা ঢাকার গাবতলী নাকি কক্সবাজারের কলাতলী।
ট্রাফিক বিভাগে নিয়োজিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দিন চৌধুরী পিপিএম জানান, জেলার একমাত্র বাস টার্মিনালটি পৌর কর্তৃপক্ষ গ্যারেজে পরিণত করে রেখেছে। দূরপাল্লার বাস তো দূরে থাক স্বল্পপাল্লার বাসগুলো এখন মহাসড়কের পাশে কাউন্টার স্থাপন করে যাত্রী সেবা দিচ্ছে। যার কারণে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। শুক্র-শনিবার অতিরিক্ত পর্যটকবাহী গাড়ি শহরে প্রবেশের কারণে পাবলিক টার্মিনালে গাড়ি পার্কিংয়ের পর ও অতিরিক্ত গাড়িগুলো মহাসড়কে পার্কিং করতে বাধ্য হয় এবং আমরা ও কিছুটা সময় ছাড় দিয়ে থাকি। পুলিশ সুপার অফিস থেকে একটি অনলাইন টার্মিনাল চালু করেছি, সেখানে সিডিউল থাকে কোন গাড়ি কোন কাউন্টার থেকে কয়টায় ছাড়াবে সেটির। চেষ্টা করছি আগত পর্যটন মৌসুমে যানজট সম্পূর্ণ নিরসনের এবং একটি পর্যটন বান্ধব ট্রাফিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য।
এদিকে যত্রতত্র বাস কাউন্টার করা নিয়ে কক্সবাজার জেরা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, বাস কাউন্টার যারা করেছে তারা ব্যবসা করার জন্য করেছে। তাদের উচ্ছেদ করার আগে যাত্রীরা যেন কোনো প্রকার হয়রানির শিকার না সেদিকে খেয়াল রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। কারণ এটি পর্যটন নগরী। এখানে বিশ্বের মানুষ ঘুরতে আসে। অন্যদিকে বাস টার্মিনালে বাস ধারণ ক্ষমতা ৬০টির। বাকি বাস কোথায় রাখা হবে তা ঠিক করে দেওয়া হবে।
কেকে/এএস