আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতিতে। এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে পিআর পদ্ধতির পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে জনমত গঠনে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে ধর্মীয় দলগুলো। জামায়াতে ইসলামী বলছে, ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতেই প্রয়োজন এ পদ্ধতি। পিআর নিয়ে মধ্যপন্থা নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
শুধু উচ্চকক্ষে এ পদ্ধতির পক্ষে দলটি। কোনো কক্ষেই পিআর পদ্ধতি না চাওয়া বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে নয় দলটি। এ অবস্থায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জরিপ বলছে, উচ্চকক্ষ গঠনে পিআর পদ্ধতির পক্ষে ৭১ শতাংশ মানুষ। তবে নিম্নকক্ষ গঠনের বিষয়ে কোনো জরিপ পাওয়া যায়নি।
পিআর প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। দেশের মানুষ নির্বাচন চায়, সংকট নিরসনের একমাত্র পথ দ্রুত নির্বাচন। যারা সংস্কার চাচ্ছে না, সেটা তাদের দলের ব্যাপার। মির্জা ফখরুল বলেন, পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে নয় তার দল। থাইল্যান্ডে ৭ দিনের চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন তিনি।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করছে, এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলেছি, আমরা পিআর পদ্ধতি কোনোমতেই মেনে নেব না। কারণ পিআর পদ্ধতিতে এই দেশের মানুষ ইউজড টু (অভ্যস্ত) না। এটি তারা বোঝেও না, তারা ঠিকমতো জানেও না।’
এদিকে ফ্যাসিবাদ যেন আর ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দরকার বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
তিনি বলেছেন, ‘বিগত ৫৪ বছরে নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতার কারণেই ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতায় এসেছিল। জনগণের আন্দোলনের কারণে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আর যাতে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে কারণেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া দরকার। আইনসভার দুই কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করতে হবে।’
গত রোববার রাজধানী ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত ‘জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
পিআর পদ্ধতির বিষয়ে ডা. তাহের আরো বলেন, ‘দেশের শতকরা ৭১ ভাগ লোক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। জনগণ জুলাই ঘোষণা ও সনদের আইনি ভিত্তি চায় এবং জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন দিতে হবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে জুলাই সনদ ও ঘোষণাকে আইনি মর্যাদা দিতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে।’
তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করুন, গোলটেবিল বৈঠক করুন, তারপর দেখুন জনগণ কী চায়। জুলাই সনদ ও ঘোষণা রাষ্ট্রপতির ঘোষণার মাধ্যমেই আইনি ভিত্তি প্রদান করা সম্ভব।’
এ সময় জনগণের দাবি আদায়ের জন্য ইসলামপন্থি ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করার আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর এই নেতা।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পরে প্রত্যাশা ছিল আইনি সংস্কার ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কার হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধতা আসবে। নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ। কিন্তু সংস্কার নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের মনোভাব, পিআর পদ্ধতিতে একমত না হওয়া এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতার পুরোনো চিত্র আমাদের আশাহত করে। গত শনিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছরের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি, জালিয়াতি ও ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের প্রতিফলন হয়নি এবং দেশ ক্রমান্বয়ে স্বৈরতন্ত্রের দিকে গেছে। যার চূড়ান্ত ও নগ্ন রূপ দেখেছি গত ১৫ বছরে।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বসে থাকবে না। আগামী নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমরা যা করতে হয় তাই করব। কাউকেই ভোট চুরি বা ডাকাতি করতে দেওয়া হবে না। কেউ অবৈধ ভোট দিতে চাইলে তাকে প্রতিহত করা হবে। কেউ মাস্তানি করতে চাইলে তাকে শায়েস্তা করা হবে। সেজন্য সারা দেশের সব শাখার সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণ বিভাগকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে হবে।
এ ছাড়া জামানত বাতিল হবে বলে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের কথা বলছে কিছু রাজনৈতিক দল বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কিমিটির সদস্য মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। গত শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি: দ্রুত বিচার সম্পন্ন, মৌলিক সংস্কার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
মেজর হাফিজ উদ্দিন বলেন, জামানত বাতিল হবে বলে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের কথা বলছে কিছু রাজনৈতিক দল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করেছে, এখন নতুন নতুন তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আজব আজব থিওরি দিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত করার কোনো কারণ নেই। এবারের নির্বাচন হবে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও অর্থনৈতিক মুক্তির নির্বাচন। নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে দলগুলো পিআর পদ্ধতির বাণী আওড়াচ্ছে।
হাফিজ বলেন, দেশের মানুষ পিআর পদ্ধতি বোঝেন না। বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া জরুরি। সংবিধানসহ অন্যান্য বিষয় সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। গণতন্ত্রকে পূর্ণভাবে বিকশিত দেখতে চাই। সরকারের অধিকাংশ সংস্কারের বিষয়ে একমত হয়েছে বিএনপি।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, এক বছরেও ন্যূনতম সংস্কার না হওয়া এই পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে। ভারতে বসে শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে দেশ অস্থিতিশীল করতে নানা কূটচালের পরিকল্পনা করেছে জানিয়ে জনগণকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান বিএনপির এই সিনিয়র নেতা।
কেকে/এআর