কোনো রাজনৈতিক দল নয়, নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রায় যোগ দিলেন হাজার হাজার মানুষ। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা- বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঘোষণা এলো। তার আগেই নানা স্লোগান, বিপ্লবী বাজনায় মুখরিত হলো পুরো এলাকা। সমাবেশে যোগ দিলেন ছাত্র-শ্রমিক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হয় ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’
সমতার দাবিতে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে হয়ে গেল ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। কর্মসূচির শুরুতেই জাতীয় সংগীত পরিবেশ করা হয়।
‘সমতার দাবিতে আমরা’ স্লোগানের এই কর্মসূচিতে প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিককর্মী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিলেন। বেলা দুইটা থেকে বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে তাদের এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আসতে দেখা যায়।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মূলত নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই কর্মসূচি। পাশাপাশি নারীদের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দীপ্ত প্রতিবাদ জানাতে কর্মসূচি হলো।
আয়োজন উপলক্ষে ৩১টি স্লোগানের একটি তালিকা করেছেন আয়োজকেরা। স্লোগানগুলোতে নারীর অধিকার, মর্যাদা, নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার, ফ্যাসিবাদের বিরোধিতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষেও স্লোগান রাখা হয়েছে।
‘গুজব ও ধর্মীয় উসকানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি থেকে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা নিশ্চিত এবং গুজব ও ধর্মীয় উসকানির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে কর্মসূচিতে পাঠ করা ঘোষণাপত্রে এই দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন জুলাই শহিদ পরিবারের তিনজন নারী সদস্য।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, যারা আমাদের সমর্থন চায় তাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারের মাধ্যমে হোক বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোক, তাদের স্পষ্ট করতে হবে নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থীদের অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ (ক্রমে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে। নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ঘোষণাপত্র পাঠকারীরা বলেন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা তারা মেনে নেবেন না। তাঁদের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র তারা প্রতিরোধ করবেন। তারা বলেন, বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে দমনমূলক অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে।
ইতিহাসবিচ্ছিন্ন কূপমণ্ডূকতার মাধ্যমে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে কিছুতেই সফল হতে দেওয়া হবে না উল্লেখ করে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমাদের সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময় ও সংবেদনশীল। সেই বিশালতাকে উপেক্ষা করে আমরা গুটিকয়েক মানুষের সংকীর্ণ ব্যাখ্যাকে সর্বজনীন হতে দেব না। আমরা অধিকার ও ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে দেব না, মর্যাদা নিয়ে কোনো ধরনের দ্ব্যর্থকতা মেনে নেব না। আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীবিষয়ক অবস্থান নজরদারিতে রাখব। যে ক্ষমতাকাঠামো এসব জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, আমরা সেই কাঠামোকে ভাঙব।’
ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নারীরা হাল ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
নারী ও পুরুষের সমতার দাবি নিয়ে গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে শুরু হয় ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচি। কর্মসূচির শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
ঘোষণাপত্র পাঠ করা শেষে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’র একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ইন্দিরা রোড ঘুরে আবারও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ফিরে আসে। মিছিলটি রাজধানী উচ্চবিদ্যালয় থেকে সেচ ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ সময় মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ‘পাহাড় থেকে সমতলে/লড়াই হবে সমান তালে’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই/লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য প্রতিরোধের দৃঢ় প্রত্যয়
প্রগতিশীল নারী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলোর আয়োজনে ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’ কর্মসূচিতে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্রে নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতা ও বৈষম্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ব্যানার, লিফলেট, স্লোগান, গান ও কবিতার মাধ্যমে নারীর অধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের দাবি তুলে ধরা হয়, যা পুরো কর্মসূচিকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
ঘোষণায় আরও বলা হয়, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে আমরা এক জরুরি মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের দাবি, একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ, যেখানে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের ভিত্তিতে সব নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে ঘোষণায় বলা হয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা, টঙ্ক, নানকার, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষা, নিরাপদ সড়ক ও ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, প্রতিটিতেই নারীর সাহসী অংশগ্রহণ রয়েছে।
তবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও নারীর পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে প্রতিক্রিয়াশীল ও পিতৃতান্ত্রিক শক্তি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, অনলাইনে হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, এবং প্রকাশ্য হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চলছে।
নারী অধিকার বিষয়ক সংস্কার-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। কিন্তু এসব সুপারিশের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যা মূল দাবিগুলোকে আড়াল করে। এ ছাড়া কমিশনের সদস্যদের জনসমক্ষে অবমাননা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার এই ন্যক্কারজনক আচরণের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। এতে স্পষ্ট হয়, সরকারের নির্লিপ্ততা আসলে মৌলিক অধিকারের দাবিদারদের দমন করারই বার্তা বহন করে।
ঘোষণায় বলা হয়, সংবিধান বা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর অধিকার অস্বীকার করা যাবে না। কৃষকের ভূমি-অধিকার থেকে শুরু করে পরিবেশগত ন্যায্যতা, সবকিছুই নারীর অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। তাই সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত না করে কোনোভাবেই ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সরকার ও ভবিষ্যৎ যেকোনও সরকারের উদ্দেশে বলা হয় নারী, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, হিজড়া ও লিঙ্গীয় বৈচিত্র্যসম্পন্ন নাগরিকদের রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কোনো শর্তসাপেক্ষ নয়।
ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়, আমাদের লড়াই শুধু নারীর মর্যাদার জন্য নয়, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সংগঠনের অধিকার, ভূমি ও সম্পত্তির অধিকার, যৌন ও প্রজনন স্বাধীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, এবং প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্যও।
পরিবেশ ধ্বংস, বিচারহীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর অনেকটিই এসব মৌলিক দাবির অন্তর্ভুক্ত, ফলে কমিশন বিলুপ্ত করার অপচেষ্টা এবং সদস্যদের প্রতি আক্রমণ নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
ঘৃণা, হুমকি, সংঘবদ্ধ সহিংসতা চালিয়ে এই আন্দোলনকে দমন করার প্রচেষ্টা চলছে-এ অভিযোগ করে প্রশ্ন তোলা হয়, সরকার কাদের তুষ্ট করতে চাইছে? সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশকে? নাকি সংস্কারের নামে বৈষম্যমূলক কাঠামো টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনাকারীদের?
সবশেষে ঘোষণা দেওয়া হয় অধিকার চেয়ে নয়, আদায় করেই নিতে হয়। আর সেই লড়াইয়ে ভয় নেই, পিছু হটার কোনো জায়গা নেই।
সমতার ডাক, অধিকার আদায়ের প্রত্যয়
গতকাল জুমার নামাজের পর থেকে বিভিন্ন ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে তাদের এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে দেখা যায়।
সেখানে উপস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘আমরা নারীর ডাকে সাড়া দিয়ে আজ এখানে এসেছি- সবাইকে এটা জানাতে যে, আমরা আমাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন এবং সেই অধিকার আদায়ে আমরা একতাবদ্ধ। এখানে আমরা কারো বিষোদগার করছি না, কোনো চিৎকার বা গালিগালাজ নেই। নারীদের একতা প্রদর্শনের জন্য আজ আমরা এখানে এসেছি।’
এনজিওকর্মী নাজিফা রায়দাহ জানান, সারা দেশে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার প্রতিবাদে এখানে এসেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর আমরা ভেবেছিলাম আমাদের অধিকারের জন্য রাস্তায় নামতে হবে না। কিন্তু আমরা ক্রমাগত দেখছি নারীরা জনসমক্ষে হয়রানি ও মারধরের শিকার হচ্ছেন, তাদের ওপর মব হামলার হুমকি আসছে। মব হামলাকারীরা নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখতে চায়। আমরা আমাদের মর্যাদা ও ন্যায্যতার জন্য এবং নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার প্রতিবাদে এখানে এসেছি।’
হিল উইমেন্স ফেডারেশন, আদিবাসী ইউনিয়ন, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, নারী মুক্তি কেন্দ্র, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চ, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ নারী জোট, নারী সংহতি, ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), তীরন্দাজ ও শ্রমিক অধিকার আন্দোলন প্রভৃতি সংগঠন এই কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে অংশ নিয়েছে।
কেকে/এআর