বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বরাবরই অস্বস্তিকর অবস্থানে থাকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বরাবরই দলটি কৌশলী অবস্থানে থাকে। যদিও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমসহ সাবেক অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগে দলটির অনেক নেতাকে ফাঁসিও দেওয়া হয়েছে। তবু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময় নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছে। যা জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
এর মধ্যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে তাদের দলের ভূমিকা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। কিন্তু তারা পুরোনো পথেই হেঁটেছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির ডাকা ‘শাহবাগ ব্লকেড’-এ কয়েকটি স্লোগান নিয়ে ফের বিতর্কের মুখে পড়েছে জামায়াত-শিবির। এমনকি ওই কর্মসূচিতে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা বন্ধের চেষ্টার অভিযোগ উঠে শিবিরের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এনসিপি বলেছে, একাত্তরে যারা জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা অবস্থান ব্যাখ্যা করবে। সেই সঙ্গে বিতর্কিত স্লোগান এবং জাতীয় সংগীত থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টার ঘটনা তাদের কোনো সদস্য করেনি বলে দাবি করেছে এনসিপি। তাদের দাবি, এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো স্লোগান দেননি। বরং এ ঘটনার জন্য পরোক্ষভাবে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের বিবৃতিতে এনসিপি বলে, তারা আশা করে, যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, তারা জাতির সামনে তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করবে।
মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে জামায়াতের ভূমিকা ও অবস্থান বেশ পুরোনো বিতর্ক। এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করায় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সম্প্রতি প্রয়াত এই নেতা এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকায় দলটি ক্ষমা না চাওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলাম এ দুটো বাংলাদেশে আপসযোগ্য নয়। একাত্তরের জন্য তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি চেষ্টা করেছিলাম ভেতরে থেকে শীর্ষ নেতৃত্বের একজন হয়ে জামায়াতকে কনভিন্স করতে, একাত্তর সালের ব্যাপারে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তিনি আরো বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস ছিল, একাত্তরের বিষয়ে আমি জামায়াতকে কনভিন্স করতে পারব। এবং এটা যদি হতো, তাহলে তা জামায়াতের জন্য ভালো হতো। কিন্তু যখন আমি দেখলাম, কোনোভাবে তাদের আমি রাজি করতে পারিনি, তখন আমি পদত্যাগ করলাম।
কেন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন এই প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, আমাদের এখানে ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি নেই। এ ছাড়া জামায়াতের মধ্যে এটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, কিছু লোক এর পক্ষে ছিল, কিছু লোক বিপক্ষে ছিল। তবে জামায়াতের ভেতরে অধিকাংশই ক্ষমা চাওয়ার বিপক্ষে ছিল। যারা জামায়াতকে পরিচালিত করেছেন এটা তাদের ব্যর্থতা।
সম্প্রতি শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচিতে স্লোগন ওঠে, ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আ.লীগের ঠাঁই নাই’। এ ছাড়া জাতীয় সংগীত পরিবেশনেও বাধা প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপি তাদের বিবৃতিতে বলে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত-পক্ষ এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও একটি পক্ষ সচেতনভাবে দলীয় স্লোগান এবং বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামবিরোধী স্লোগান দিয়েছে, যা জুলাই পরবর্তী সময়ে সাম্প্রতিক আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য নবায়নের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
এনসিপি বলেছে, আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, এনসিপির কোনো সদস্য সাম্প্রতিক আন্দোলনে দলীয় স্লোগান কিংবা এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো স্লোগান দেয়নি। ফলে যেসব আপত্তিকর স্লোগান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পক্ষকেই বহন করতে হবে। আমরা আরো লক্ষ করেছি, আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশনার সময় একটি পক্ষ আপত্তি জানালেও তারা দৃঢ়তার সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জনআকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।
এদিকে, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এ কথা বলেন তিনি। মাহফুজ আলম বলেন, ৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে-বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।
এদিকে, জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে এনসিপির বিবৃতির তীব্র সমালোচনা করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, জামায়াত-শিবিরকে কাজে লাগানো শেষে এখন তাদের পাকিস্তানপন্থি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পোস্টে তিনি লেখেন, আ.লীগ নিষিদ্ধের কর্মসূচিতে যমুনা বা শাহবাগ ঘেরাওয়ে সর্বশক্তি নিয়ে উপস্থিত ছিল জামায়াত-শিবির। জাশি ও এনসিপির নেতাদের একসঙ্গে বসে ও দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। ... মূলত তারা উপস্থিত না হলে আন্দোলনটা জমত না। তবে আন্দোলন আংশিক সফল হওয়ার পরে কেন যেন এনসিপির নেতারা জামায়াত-শিবিরের তকমা থেকে বের হতে চাচ্ছে।
এদিকে, সময় থাকতে রাজাকারদের বাংলা ছাড়ার হুংকার দিয়েছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার। গতকাল সোমবার এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন। ওই পোস্টে বাকের বলেন, ‘তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়! লাখো শহিদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না! গোলাম আযম তুই রাজাকার, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?’ এই পোস্টের পরপরই আরেকটি পোস্ট দেন বাকের। সেই পোস্টে তিনি বলেন, ‘হাসিনাকে সরায়ে গোলাম আযমের জন্য আমরা জুলাইয়ে রক্ত দেই নাই।’
ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইলেন শাখা ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে তারা অবস্থান নিয়ে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন।
এর আগে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হতে থাকেন। এসময় তারা ‘একাত্তরের শহিদরা, লও লও সালাম’, ‘চব্বিশের শহিদরা, লও লও সালাম’, ‘একাত্তরের বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’, ‘তুমি কে আমি কে, বাংলাদেশি বাংলাদেশি’, ‘পাকিস্তানের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’ স্লোগান দেন।
কর্মসূচির আয়োজক বিজয় একাত্তর হল ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক সাকিব বিশ্বাস বলেন, শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রোগ্রামে বাংলাদেশবিরোধীরা বাংলাদেশের অবমাননা, বাংলাদেশি জাতিসত্তার প্রশ্নে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তারই প্রেক্ষিতে আমরা এখানে একত্র হয়েছি। জাতীয় সংগীতের অবমাননা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি ব্যবস্থা নেয় আমরা তাদের পক্ষে থাকব।
ছাত্র ইউনিয়নের মেঘমল্লার বসু বলেন, বাংলাদেশে যদি এখনো মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করা হয় তাহলে রাজনৈতিক মত-নির্বিশেষে মানুষ এখনো প্রতিরোধ করতে জানে, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে এটা জানিয়ে দিতে হবে। একটা জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ করতে করতে কৃষক দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে। জাতীয় সংগীতে কী সমস্যা আছে সেটা তারা বলুক। আসলে বিষয়টা শুধু জাতীয় সংগীত না, বিষয়টা জাতীয় পতাকা-মুক্তিযুদ্ধও। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি ৫৫ বছরেও পরাজয় মানতে নারাজ এবং তারা মনে করে চব্বিশ তারা ঘটিয়েছে। এটা বিপজ্জনক। কাজে চব্বিশের পক্ষে-অভ্যুত্থানের পক্ষে যারা ছিল তারা স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফালন দেখে শঙ্কিত। তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় হয়েছে।
এর আগে গত ১০ মে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ তিন দাবিতে শাহবাগে অবরোধ চলাকালে জাতীয় সংগীত গাইতে বাধা দেওয়ার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
কেকে/ এমএস