চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘আমদানি’ নামে পরিচিত ওয়ার্ডটি বন্দিদের জন্য এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার নাম। এ ওয়ার্ডে নতুন আগত বন্দিদের প্রথমবার রাখার নিয়ম প্রচলিত থাকলেও বাস্তবে এটি যেন এক ‘জাহান্নাম’। জামিনে মুক্তি পাওয়া অনেক বন্দি এখনো ভুলতে পারছেন না আমদানিতে কাটানো সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বন্দি প্রথমবার কারাগারে প্রবেশ করলে তাকে অন্তত দুই দিন ‘আমদানি’ ওয়ার্ডে রাখা হয়।
বন্দিদের মতে, এটি শুধু আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়, এটি যেন শাস্তির সূচনাবিন্দু। এ ওয়ার্ডে নেই পর্যাপ্ত ঘুমানোর জায়গা, নেই খাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ, গোসল নিষিদ্ধ, এবং শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগও সীমিত। প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বন্দিকে এক জায়গায় গাদাগাদি করে রাখা হয়। যা বন্দিদের মধ্যে নানা শারীরিক ও মানসিক রোগের বিস্তার ঘটায়। গরমের সময় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। অধিকাংশ ফ্যান অকেজো এবং যে কয়টি সচল রয়েছে সেগুলোর গতি এতই কম যে গরমে বন্দিরা হাঁসফাঁস করতে থাকেন। পর্যাপ্ত পানির অভাব এবং নোংরা পরিবেশ বন্দিদের অসুস্থ করে তোলে।
জামিনে মুক্তি পাওয়া এক বন্দি বলেন, ‘আমদানিতে আমাদের পায়খানার দরজা পর্যন্ত খোলা যায় না। দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়ানো যায় না। কারা কর্তৃপক্ষ যে খাবার সরবরাহ করে তাও খাওয়ার অনুপযুক্ত। এই দুদিন মনে হয়েছিল যেন আমি আর কখনো জীবিত বের হতে পারব না। আমদানিতে বন্দিদের ডাকা হয় গরু।’ ‘আমদানি’ ওয়ার্ডের বন্দিদের জন্য পানির ব্যবস্থাও নাজুক। যেটা দিয়ে গোসল তো দূরের কথা, মুখ ধোয়ার সুযোগও মেলে না ঠিকমতো। তীব্র গরমে ঠিকমতো গোসল করতে না পেরে বন্দিরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, অথচ প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থাকে না।
বন্দিদের দাবি, এ ওয়ার্ডে থাকা প্রতিটি ঘণ্টা যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষা। তীব্র মানসিক চাপে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। অথচ এসব ব্যাপারে কারা প্রশাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটিও একটি আলাদা বাণিজ্যের অংশ।
কারা সূত্রে জানা গেছে, ভালো ওয়ার্ডে যেতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। অর্থাৎ, বন্দিদের পরিবারগুলোকে ঘুষ দিতে হয়। যে বন্দি বেশি টাকা দেয় সে ভালো ওয়ার্ড পেয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দিদের প্রতি এমন আচরণ শুধু আইন ও মানবাধিকারের পরিপন্থি নয়, এটি সমাজে অপরাধপ্রবণতা আরো উসকে দেয়। কারাগারে সংশোধনের সুযোগ তো দূরের কথা, বন্দিরা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি। মানবাধিকার সংস্থা ‘বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘কারাগার শাস্তির জায়গা নয়, কারাগার মানে হচ্ছে সংশোধনাগার। কারাগারে আটক বন্দিদেরও মানবাধিকার আছে। তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। অন্যসব জায়গার মতো কারাগারে সংস্কার প্রয়োজন। সরকারকে এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। কারাগারে ধারণক্ষমতার বেশি বন্দি রয়েছে। যে কারণে তারা থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে কষ্ট পাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘খাবারের মান খারাপ এবং বন্দিদের নানাভাবে হয়রানি করে অর্থ আদায়ের বিষয়টি তার জানা নেই বলেও জানান। এরপরও তিনি বলেন, এসব বিষয়টি খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কেকে/ এমএস