বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিএমডিএ) চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাবেক নির্বাহী পরিচালক (ইডি) শফিকুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ৭ এপ্রিল নতুন ইডি হিসেবে অতিরিক্ত সচিব তরিকুল আলমকে নিয়োগ দিলেও এতে অসন্তোষ প্রশমিত হয়নি। কর্মকর্তাদের দাবি, বিএমডিএ প্রকৌশলভিত্তিক সংস্থা হওয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ পদে অনুপযুক্ত।
এদিকে এক প্রকৌশলীর বাধ্যতামূলক অবসর ও দুজনের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা একটি তদন্ত কমিটির কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ইডি নিযুক্ত হওয়া শফিকুল ইসলামকে গত ফেব্রুয়ারিতে রেশম উন্নয়ন বোর্ডে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি অফিস ছাড়তে না চাইলে ২৩ মার্চ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি দল তাকে দফতর ত্যাগে বাধ্য করেন। পরে তিনি ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং অজ্ঞাতনামা আরো ৬০ জনকে আসামি করেন। এ ঘটনার জেরে তত্ত্ববাবধায়ক প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, দুজন প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করা হয় এবং আরো আটজনকে শোকজ করা হয়। যা গত ৮ এপ্রিল তাদের হাতে পৌঁছায়। একের পর এক এ পদক্ষেপের ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, শফিকুল ইসলামকে আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারের পরিবর্তনের পর তিনি দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলি করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি দয়িত্ব হস্তান্তর করার পরও দুর্নীতির মাধ্যমে ৫৯ জনকে বদলি করেছেন।
এ ছাড়া বদলির পরও তিনি একাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করেন, যা সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলে। যারা আগের সরকারের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, তাদের পুরস্কৃত করা হয়, আর বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
সূত্রমতে, বদলির আদেশের পরও ইডি শফিকুল গত ১৩ মার্চ দুটি আদেশে ২৫ জন, ১৮ মার্চ ২৭ জন, ৮ এপ্রিল ৫ জন ৯ এপ্রিল ২ জন। আর যেসব কর্মচারী জুলাই আন্দোলন দমনে সরাসরি লাঠি হাতে মাঠে নামেন তাদের বহাল রাখা হয়। ইডির বদলির আদেশের পর মাহফুজুর রহমান কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের ডেকে মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদনপত্র পাঠানোর নির্দেশনা দেন। এতে শফিকুল ইসলামকে বিএমডিএতেই রাখার দাবি জানাতে বলা হয়।
এসব বিষয় নিয়ে শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে বিএমডিএর ভারপ্রাপ্ত সচিব এনামুল কাদির বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা অস্থিরতা রয়েছে, তবে এ বিষয়ে মন্তব্য করা এখনই ঠিক হবে না। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের অধীন।
তত্ত্ববাবধায়ক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমানের প্রভাবের কথাও উঠে এসেছে, যিনি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের নেতা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইডির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দফতর চালাতেন এবং বিভিন্ন টেন্ডার অনিয়মে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে সেচ প্রকল্পের টেন্ডারে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। টেন্ডারের গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় তদন্তের বদলে ইডি টেন্ডার বাতিল করেন।
গত ৯ ডিসেম্বর ভূ-গর্ভস্থ সেচনালা বর্ধিতকরণের মাধ্যমে সেচ এলাকা সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ৯৫টি লটের বিপরীতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এ টেন্ডারের অন্তত ৩০টি লটের গোপন দরপত্র পিডি শহীদুর রহমান তৎকালীন ইডি শফিকুলের নির্দেশে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাফুজুর রহমানকে জানিয়ে দেন বলে অভিযোগ আছে। বিষয়টি জানাজানি হলে পিডি শহীদুর রহমান শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান ড. এম আসাদুজ্জামান ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে বিষয়টি ইডিকে অবহিত করেন। কিন্তু ইডি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে দ্রুত টেন্ডার বাতিলের ব্যবস্থা করেন।
এদিকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) এক প্রকৌশলীর বাধ্যতামূলক অবসর ও দুজনের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেছেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা একটি তদন্ত কমিটির কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল বিচারপতি রাজিক-আল-জলিল ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদির বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগে গত ২৫ মার্চ বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে ২৭ মার্চ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। উচ্চ আদালত এ বাধ্যতামূলক অবসর, সাময়িক বরখাস্ত ও তদন্ত কমিটি গঠনের মন্ত্রণালয়ের আদেশ স্থগিত করেছেন।
বিএমডিএর ওই তিন প্রকৌশলীর আইনজীবী মো. ফরিদুল ইসলাম জানান, যেসব স্মারকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে বাধ্যতামূলক অবসর, দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল; সেসব স্মারকের আদেশগুলো উচ্চ আদালত ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। পাশাপাশি তদন্ত কমিটি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করছিল, এটি উচ্চ আদালতকে জানানো হয়েছে। তাই তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশও স্থগিত করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস