বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এক সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তুলনামূলক স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। ২০০৬-২০০৮ সালের নির্বাচন প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দেয়, নির্দলীয় প্রশাসন ছাড়া কোনো জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়নি। এই সময় জনগণের ভোটে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়া বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে এ ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাতিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনকে ঘিরে শঙ্কা ও বিতর্ক অব্যাহত ছিল। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পর যে তিনটি নির্বাচন হলো, তাতে দেশের মানুষের ভোট দিতে যেতে হয়নি। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোট, ২০১৮ সালে ‘দিনের ভোট রাতে’, আর ২০২৪ সালে সরকার নির্বাচনের নামে আমি-ডামির অভিনব নির্বাচন আয়োজিত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অপরের ওপর সন্দেহের চোখ রাখে, তখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আরও জটিল হয়ে পড়ে।
এবারের সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায়Ñ পুরোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পথ খোলার, একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংকেত দিচ্ছে। এটি শুধু একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয়, বরং গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনগণের রাজনৈতিক বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করতে এবং সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। দেশের জন্য এটি শুধুমাত্র একটি আইনগত প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরীক্ষা।
তবে বাস্তবায়নের পথে একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, ভোটার সচেতনতা এবং সময়োপযোগী আইনগত কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও যদি কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা না থাকে, তবে এটি কেবল নামমাত্র ব্যবস্থা হিসেবে থেকে যাবে। এজন্য সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক ঐক্য ও দায়িত্বশীলতা অপরিহার্য। দেশের জনগণ অপেক্ষা করছে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তি একদিনে আসে না। আইনি রায় এবং রাজনৈতিক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রণালিবদ্ধ প্রস্তুতি নিতে হবে, যাতে নির্বাচনি প্রক্রিয়া সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেরার পথ গণতন্ত্রের জন্য পরীক্ষার মুহূর্ত হলেও, এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে আমাদের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। আমাদের রাজনৈতিক সমাজের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে আমরা কেবল বিচারক বা আইনগত সিদ্ধান্তের আলোকে নয়, বরং গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে। এখনই সময় দায়িত্বশীলতা ও সমন্বয়মূলক পদক্ষেপের, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
কেকে/এআর