ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জোটবদ্ধ রাজনীতিতে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী। নতুন নিয়ম অনুযায়ী- জোট গঠন করলেও প্রত্যেক দলকে নিজ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ফলে জোটে থেকেও বড় শরিকের প্রতীকের সুবিধা না পাওয়ায় ছোট রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের মাঠে জয় পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি নিবন্ধিত দল আরপিও’র ২০ (১) ধারার সংশোধনী বাতিলের দাবি জানিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনে শরিকদের নিয়ে আসন সমঝোতার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, শরিকদের মনোনীত আসন নিয়ে যেমন জটিলতা আছে, তার চেয়েও বড় সমস্যা হলোÑ জোটগত নির্বাচনে প্রতীক-সংক্রান্ত নতুন বাধ্যবাধকতা। দলটির ভাষ্য, ছোট দলগুলোকে নিজেদের প্রতীকে ভোট করতে বাধ্য করলে তাদের প্রার্থীদের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যাবে। এতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুবিধা নিতে পারে বলেও মনে করছে দলটি।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আরপিও সংশোধনীর ফলে সাময়িকভাবে ছোট দলগুলোর কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও, এটির ভালো দিকও রয়েছে। যার মাধ্যমে নির্বাচনে নিজেদের দল ও প্রতীকের পরিচিতি বাড়বে। এ ছাড়া নিজ দলের অবস্থান তৈরি না করে, কেবল বড় দলের সঙ্গে জোট এবং অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হওয়ার চিন্তাও উচিত নয় বলে মত তাদের।
এ প্রসঙ্গে কথা হলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খোলা কাগজকে বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা- এটা আমার নীতিগত সিদ্ধান্ত। তবে এবারের নির্বাচনের জন্য সেকেন্ড অপশনটাও থাকা উচিত। যেহেতু সময় কম, দলগুলোও পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেনি। এ ছাড়া আমরা মনে করি- এটা (আরপিও সংশোধন) করা হয়েছে, কাউকে চাপে রাখা এবং কাউকে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য।’
আরপিও সংশোধনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই তারা এটি তৈরি করে ভেটিংয়ে দিয়েছেন এবং উপদেষ্টামণ্ডলী তা চূড়ান্ত করে অর্ডিন্যান্স জারি করেছেন। যদিও এটা নিয়ে আমরা ইসির সংলাপে বলেছি- যেন এটি পুনর্বহাল করা হয়। তা না হলে এবার অনেক দলের জন্য নিজস্ব মার্কা নিয়ে জয়ী হওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ ছাড়া কেউ যদি নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে চায়, সেই অপশন তো আছেই। পাশাপাশি সেকেন্ড অপশনটাও রাখা উচিত বলে মনে করি।’
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী খোলা কাগজকে বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের ফলে ছোট দলগুলোর কিছু সমস্যা হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে দলের পরিচয় এবং প্রত্যেক দলের প্রতীকের পরিচয় পাওয়াও প্রয়োজন। নিজ প্রতীকে নির্বাচন করা, এটা দলের জন্যও তো ভালো। সে হিসেবে আমরা এই সিদ্ধান্তকে খারাপ মনে করি না। একইসঙ্গে স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষ যারা বড় দলের প্রতীক নিয়ে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখে; তাদের সুযোগটাও কমে যাবে।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন রাজ্জাক খোলা কাগজকে বলেন, “আরপিও সংশোধনের ফলে তুলনামূলকভাবে ছোট দল বা কম পরিচিত প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হবে। কারণ বাংলাদেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে প্রতীক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আমরা এটিকে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। আমাদের দল ‘ছাতা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। জনগণের সমর্থন ও আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমরা ‘ছাতা’ মার্কা নিয়েই নির্বাচন মাঠে নামব- ইনশাআল্লাহ।”
বিএনপির সম্ভাব্য শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী খোলা কাগজকে বলেন, ‘জোট করা যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, তেমনি জয়ের সম্ভাবনা বাড়াতে পরিচিত প্রতীকে ভোট করার অধিকারও গণতান্ত্রিক। আরপিওর সংশোধনী সেই অধিকার খর্ব করছে। আমরা আগের বিধান পুনর্বহাল চাই।’
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) মহাসচিব মোহাম্মদ মোমিনুল আমিন মনে করেন, আরপিও সংশোধিত বিধান বাংলাদেশের বাস্তব রাজনীতি ও ভোট-সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ভোট প্রকৃতপক্ষে প্রতীকনির্ভর। মানুষ জোটের নাম দেখে নয়, প্রতীক দেখে ভোট দেয়। জোট করে আবার ভিন্ন প্রতীকে দাঁড়াতে বাধ্য করা মানে- জোটকে কাগজে রাখা, কিন্তু ব্যালট থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া।’
তার মতে, এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ও উদীয়মান দলগুলো। বড় দলের প্রতীকের সঙ্গে থাকার মাধ্যমে যে সামান্য রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও ব্র্যান্ডিং তারা পায়, সেটিও হারাবে। একই জোটের প্রার্থী ভিন্ন প্রতীকে দাঁড়ালে ভোটার বুঝতেই পারবে না- কাকে ভোট দিলে জোট শক্তিশালী হবে। এতে ভোট বিভাজিত হয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বড় দলগুলোর একচেটিয়া প্রভাব আরো বাড়বে। এ সময় তফসিলের ঠিক আগে এমন পরিবর্তন ছোট দলের নির্বাচনি প্রস্তুতি ও কৌশল নির্মাণকে পুরোপুরি অচল করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন এনডিএম মহাসচিব।
কেকে/ আরআই