জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় সমবায়ের আড়ালে গড়ে ওঠা ছদ্ম ব্যাংকিং প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাজারো পরিবার। নামমাত্র নিবন্ধন নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব সমবায় প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের সঞ্চিত অর্থ হাতিয়ে নেয়।
শুরুর দিকে নিয়মিত মুনাফা প্রদান করে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করলেও ধীরে
ধীরে একের পর এক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে অধিকাংশ
অফিসেই তালা ঝুলছে। সমবায় দপ্তরের হিসেবে, প্রায় ৩২ হাজার গ্রাহকের ৭২০ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অধিকাংশ পরিচালকেরা লাপাত্তা। তবে ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রকৃত অঙ্ক দেড় হাজার কোটিরও বেশি।
প্রতারণার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন
টাকা উদ্ধারের দাবিতে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘদিন ধরে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, মিছিল, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও উপজেলা পরিষদ ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। আশ্বাসের ভিত্তিতে আন্দোলন স্থগিত করলেও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) থেকে তারা আবারও আন্দোলনে নামেন।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টানা সপ্তম দিনের মতো কয়েক হাজার আন্দোলনকারী গ্রাহক উপজেলা পরিষদ ঘেরাও করে সকল দপ্তরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দপ্তর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ফলে বিভিন্ন কাজে আগত সেবাগ্রহীতারা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। সহায়ক কমিটির ব্যানারে আয়োজিত এ কর্মসূচিতে ভুক্তভোগীদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও অংশ নেন।
ঝুঁকিপূর্ণ সমবায়ের তালিকা
জেলা সমবায় দপ্তরের তথ্যমতে, মাদারগঞ্জে ২৩টি সমবায় সমিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব সমিতির গ্রাহক সংখ্যা ৩২ হাজার ৪২৪ জন, এবং আত্নসাৎ করা অর্থের পরিমাণ ৭২০ কোটি ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ১৫০ টাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, প্রবাসী, দিনমজুর, পোশাকশ্রমিক থেকে শুরু করে চাকরিজীবী পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব সমবায়ের নিবন্ধন নিয়ে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জামালপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজমের মদদে দলীয় নেতারা এসব সমবায়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি জামায়াতের নেতারাও একইভাবে সমবায়ের নামে অর্থ হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তারা দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্তরা ফেরত পাননি তাদের অর্থ। এই প্রতারণার প্রভাবে পুরো উপজেলায় দেখা দেয় ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
মাদারগঞ্জে সমবায়ের চিত্র
উপজেলায় সাত ক্যাটাগরিতে মোট ১৮১টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে—
১. বহুমুখী সমবায়: ২৮টি
২.সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায়: ৩১টি
৩.ব্যবসায়ী সমবায়: ২৫টি
৪.কৃষি সমবায়: ৭৯টি
৫.শ্রমজীবী সমবায়: ১৩টি
৬.মহিলা সমবায়: ১টি
৭. মৎস্য সমবায়: ৪টি
এসবের মধ্যে ৭৪টি সমিতির কার্যক্রম প্রায় বন্ধ।
ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষিত ২৩টি সমবায়ের মধ্যে রয়েছে— আল-আকাবা, স্বদেশ, শতদল, নবদ্বীপ, আশার আলো, জনকল্যাণ, পরশমণি, দারিদ্র্য বিমোচন, হলি টার্গেট, স্বপ্নতরী, আল-আকসা, রূপসী বাংলা, শ্যামল বাংলা, মাতৃভূমি, স্বাধীন বাংলা, অগ্রগামী, রংধনু, আল-আমানত, দরিদ্র শ্রমজীবী, আল-ইনসাফ, জনতা শ্রমজীবীসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান।
সিআইডি তদন্ত ও সম্পদ ক্রোক
মানিলন্ডারিং মামলায় সিআইডি ইতোমধ্যে আল-আকাবা সমবায়ের পরিচালকদের প্রায় ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—
১.গাজীপুরে আলফা ড্রেসওয়্যার গার্মেন্টস
২.জামালপুরে আলফা ইটভাটা
৩.ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৯টি প্লট
৪.মোট ৩১১৩ শতাংশ জমি
ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আমানতকারী জানান, দুই বছর ধরে তারা আন্দোলন করছেন। শতদল সমবায়ের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর সম্প্রতি আমানতের টাকা পরিশোধে ১ কোটি ৫ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছেন বলেও তারা জানান।
তাদের অভিযোগ, কিছু পরিচালক টাকা দিলেও তা সঠিকভাবে আমানতকারীদের মাঝে বণ্টন না করে থানার ভল্টে রাখা হচ্ছে। ভল্টের চাবি একদিকে পরিচালকের কাছে এবং অন্যদিকে আমানত উদ্ধার কমিটির সদস্যদের কাছে থাকায় সন্দেহ বাড়ছে।
উদ্ধার কমিটি, প্রশাসন ও পুলিশের বক্তব্য
আমানত উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক শিবলুল বারী বলেন, বছরের পর বছর আন্দোলন চলছে। প্রশাসনের ভূমিকা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকা সত্ত্বেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
মাদারগঞ্জ থানা পরিদর্শক (ওসি) মো. সাইফুল্লাহ সাইফ বলেন, দুই সমিতির দেড় কোটি টাকা থানায় রক্ষিত আছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদির শাহ বলেন, উপজেলা পরিষদের সব দপ্তরের কার্যক্রম ঘেরাওয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে। সেবাগ্রহীতারা কোনো অফিসে প্রবেশ করতে পারছেন না। আমরাও দুর্ভোগে পড়েছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
কেকে/লআ