দেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে স্পষ্ট রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ করা যাচ্ছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০ শতাংশ তরুণ এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি কোন দলকে ভোট দেবেন। আরো ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ পছন্দের দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যারা ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ বিএনপি, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ এবং ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিকে (এনসিপি) সমর্থন করেছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে আগ্রহী হলেও, তাদের মধ্যে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ এখনো সিদ্ধান্তহীন কাকে ভোট দেবেন তা নিয়ে।গতকাল বুধবার রাজধানীর বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারে (বিওয়াইএলসি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে ২০২৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়। দেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আকাক্সক্ষা বোঝার লক্ষ্যে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে দেশের আটটি বিভাগের ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ২ হাজার ৫০০ তরুণ-তরুণীর মতামত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন সংস্থাটির গবেষণা, মনিটরিং ও মূল্যায়ন বিভাগের ব্যবস্থাপক মো. আবুল খায়ের সজীব। গবেষণায় তার সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের নির্বাহী মুশফিকুর রহমান খান মজলিশ।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, ৮৯ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটারে ৯৭ দশমিক ২ শতাংশ আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে ইচ্ছুক। ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। এ ছাড়া ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে তারা জনসমক্ষে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশে বেশি নিরাপদ বোধ করেন বলে জানিয়েছেন।
অধিকাংশ তরুণ অর্থাৎ ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায়সঙ্গত ও নির্বিঘ্ন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাবকে, ২৩ দশমিক ৮ শতাংশ সহিংসতা ও সংঘর্ষকে এবং ১১ দশমিক ১ শতাংশ ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহারকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আগামী পাঁচ বছরে দেশের অগ্রাধিকার বিষয়ে ৬৭ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ দুর্নীতি নির্মূলকেই দেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক সম্প্রীতি বিষয়ে ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, ধর্ম ও জাতিগত দিক থেকে বাংলাদেশে এখনো সম্প্রীতি বজায় আছে। তবে ৭৬ শতাংশ তরুণ মনে করেন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে নারীরা নিরাপদ নন, যা স্থায়ী লিঙ্গভিত্তিক অনিরাপত্তার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে এবং তাৎক্ষণিক নীতি-মনোযোগ দাবি করে।
জরিপে বলা হয়, ভবিষ্যৎ আকাক্সক্ষার বিষয়ে ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী, আর ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ জানিয়েছেন যে, তারা ভবিষ্যতে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিকল্পনা করছেন, যার পেছনে মূল কারণ হলো কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ও সামাজিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণ মনে করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না।
এইসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তরুণদের মাঝে আশাবাদ লক্ষ্য করা গেছে- ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক ও আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছেন, যা তাদের দৃঢ়তা, আশা এবং দেশের অগ্রগতিতে বিশ্বাসের প্রতিফলন।
অনুষ্ঠানে ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হতে চায়। এর পেছনে বড় কারণ চাকরি বাজারে যথেষ্ট সুযোগ না থাকা। অনেকে বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তা হতে চায়। তবে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ তাদের নেওয়া দরকার, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তা দেওয়া হয় না।
বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডাক্তার আব্দুন নূর তুষার বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে নানা ভাবনা কাজ করে। তারা শিক্ষা নিয়ে ভাবে। জীবিকা নিয়ে ভাবে। তাদের রাজনৈতিক ভাবনাও আছে। নানা বিষয় নিয়ে তারা হতাশাও ভোগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ও ইতিবাচক।
বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনাহ আহমেদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিওয়াইএলসি তরুণদের নিয়ে কাজ করে বলে দেশ ও সমাজ গড়ে তোলার ভূমিকায় তরুণদের সম্পৃক্ততা আর তাদের মতামত আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমীক্ষা দেখায় যে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সামাজিকভাবে জাগ্রত এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। তরুণরা তাদের আকাক্সক্ষা ও আশঙ্কার কথা বলেছেন এবং তারা অনিশ্চয়তার মধ্যেও অনেক আশাবাদী। তাদের কথা শোনা, তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা এবং তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিনির্ধারণ করা এখন ভীষণভাবে জরুরি।’
শান্তি ও ন্যায়বিচার বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে বিওয়াইএলসি-এর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‘সামনের দিনে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবেন কিংবা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যাবেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা ফেরানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াটা খুবই জরুরি।
বিওয়াইএলসির লিড ফ্যাকাল্টি মুনিরা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের দেশের তরুণদের আছে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতা। তাদের শুধু সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং উন্নতির সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।’
প্রসঙ্গত, ১০ থেকে ২১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখের মধ্যে পরিচালিত এ সার্ভে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগে ২৭টি জেলা ও ১৭৫টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মোট ২,৫৪৫ জন তরুণ অংশগ্রহণ করেন। বিওয়াইএলসি প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সার্ভে পরিচালনা করে, যাতে তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়।
কেকে/এআর