বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: বৃহস্পতিবারের উল্লেখযোগ্য সাত সংবাদ      ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়াহ’      নির্বাচনে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী : ইসি সচিব      ৪৫তম বিসিএস নন-ক্যাডারের ফল প্রকাশ, সুপারিশ পেলেন ৫৪৫ জন      বন বিভাগে সুফল প্রকল্পে দুর্নীতি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার দাম্ভিকতা      ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হলে কৃষি অর্থনীতি টেকসই হবে : কৃষি সচিব      ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়া হবে না : ধর্ম উপদেষ্টা      
খোলাকাগজ স্পেশাল
সংকটে মৌলভীবাজারের তাঁতশিল্প
মো. এহসানুল হক, মৌলভীবাজার
প্রকাশ: সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:১৫ এএম আপডেট: ০৩.১১.২০২৫ ১০:২৬ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

দেশের মণিপুরীদের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা। মণিপুুরির এক একটা ঘর মানেই এক একটি তাঁতশিল্পের ছোট কারখানা। কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, তিলকপুর, মাধবপুর এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামনগর মণিপুরি পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মণিপুরি সম্প্রদায়ের বসবাস। এসব এলাকার শতকরা ৯০ ভাগ মণিপুরী মহিলা ও পুরুষ তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে এসব অঞ্চলের মণিপুরি জনগোষ্ঠীর তাঁতশিল্পীদের ২০০ বছরের ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। 

সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অব্যাহত লোকসানে দুর্দিন নেমে এসেছে তাঁতিদের। টিকতে না পেরে অনেকে ছেড়েছেন এ পেশা। আবার বাপ-দাদার পেশা বলে অনেকেই এটি আগলে ধরে আছেন। এমন অবস্থায় সুতা-রংসহ আনুষাঙ্গিক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও আধুনিক পোশাক কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁতিদের। এ পেশায় জড়িত প্রায় পাঁচ হাজার মণিপুরি নারী কর্মহীন হয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। 

মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কয়েকজন দৈনিক খোলা কাগজের প্রতিবেদককে জানান, তাদের জীবিকার এক সময়ের প্রধান  অবলম্বন এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরিচায়ক ধ্বংসে একটি বিশেষ মহল জড়িত। তারা মণিপুরিদের আদলে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য তৈরি করে বাজারে ছেড়েছিল। বাজার থেকে নিজেদের মুনাফা লুফে নিয়ে তারা সরে পড়েছে। মানহীনতার দায় কাঁধে নিয়ে দুর্নাম আর ভোগান্তি বইতে হচ্ছে এখন মণিপুরিদের। 

বিশেষ করে ২০২২-২৩ সাল থেকে একটি কুচক্রি মহল কমলগঞ্জের আদমপুর বাজারে উইভিং ফ্যাক্টরি স্থাপন করে এবং কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে একই ধরনের কারখানা নির্মাণ করে মণিপুরি শাড়ির অনুকরণে নিম্নমানের কাপড় তৈরি করে কম দামে বাজারে ছাড়ে। বিশেষ করে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি উপজেলা, টাঙ্গাইল জেলার কটোরিয়া বাজার, ঢাকা, সিলেট, শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারী ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায় নকল মণিপুরি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। 

বাংলাদেশের দুই জেলায় ফ্যাক্টরি থাকার সুবাধে বিভিন্ন ডিজাইনের অর্জিনাল মুনিপুরি শাড়ি ক্রয় করে তা রংপুর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে নিম্নমানের সুতা দিয়ে খুব অল্প দামে বাজারজাত করছে। ফলে তাদের আসল পণ্য দামের কারণে বাজার হারাতে থাকে। একপর্যায়ে মানহীনতার দায় নিয়ে ধসে পড়ে তাদের এই পণ্যের বাজার। তবে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সরব হয়েছেন এই জনগোষ্ঠীর দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন। 

সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর কমলগঞ্জের ভানুবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটিবেইজ পর্যটনকেন্দ্রে মণিপুরি হস্তশিল্পী ও স্থানীয় বাসিন্দারা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে এ বিষয়ে সরকারকে বার্তা দেন। ভুক্তভোগীরা জানান, ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে এসে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের ভানুবিল মাঝেরগাঁওসহ বিভিন্ন গ্রামে বসতি গড়ে তুলেছিলেন তাদের পূর্বজনরা। নিজেদের জীবন ও জীবিকার অন্যতম মাধ্যম এবং জাতিগত ঐতিহ্যের শৈল্পিক কাজকে শুরু থেকেই চর্চা করে আসছেন তারা। তাঁতশিল্পের বিনাশকে তারা তাদের জাতিগত পরিচয় বিলুপ্তির অশনিসংকেত হিসেবে বিবেচনা করছেন। এটিকে রক্ষায় তারা সরকারসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের সহায়তা প্রত্যাশা করেন। 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আদমপুরবাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর মুন্না রানা, কলাবতী শাড়ি তৈরি করে দেশব্যাপী সাড়া জাগানো রাধাবতী দেবী, ডা. কায়াম উদ্দিন, মণিপুরি কবি সনাতন হামহাম, ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদসহ অনেকেই। 

এসময় মণিপুরী হস্তশিল্পের তাঁতি ও ব্যবসায়ী সরকারের কাছে দাবি জানান। দাবিগুলো- নকল শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাসহ সকল নকল মণিপুরী উইভিং ফ্যাক্টিরি বন্ধ করা, বাজারে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের নজরদারি বাড়ানো, আসল তাঁতপণ্যের জিআই সনদের সঠিক বাস্তবায়ন করা, তাঁতিদের প্রশিক্ষণ, ডিজাইন উন্নয়ন ও স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দেওয়া, মৌলভীবাজার কমলগঞ্জের আদমপুর বাজারে মণিপুরি তাঁতপণ্য সার্টিফিকেশন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করা। জানা যায়, মণিপুরি, খাসিয়া বা চাকমা, আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথার অনুসারী। এই আদিবাসী নারীরাই মূলত বংশ পরম্পরায় তাঁতবস্ত্রের মতো কুটির শিল্পের উদ্ভাবক ও মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরে রেখেছেন ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য। বর্তমানে দুর্দিন নেমে এসেছে এসব তাঁতবস্ত্রের বাজারে। স্থানীয় পর্যায়ে এর যেটুকু চাহিদা আছে তাকে পুঁজি করে কিছু কিছু পরিবার চলছে। মৌলভীবাজার অঞ্চলের অন্তত ৫ হাজার মণিপুরি নারী তাঁতবস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। 

তারা বলছেন, বাজার না থাকায় নতুন প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষেত্র  থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। এই খাত ধ্বংস হয়ে গেলে বর্তমানে এর সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রায় ৫ হাজার নারী বেকার হয়ে যাবেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকেই বলছেন ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চলের এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য বাজার মাতিয়েছে। আদিবাসী গোষ্ঠীর অন্যতম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও ছিল এটি। মণিপুরি তাঁতপণ্য দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধনও পেয়েছে। কিন্তু আধুনিক বাজারের উপযুক্ত করে এটিকে নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা দেখা যায়নি। 

কমলগঞ্জের মাঝেরগাঁওয়ের কল্পনা দেবী ও গীতা দেবী জানান, এক সময় ভানুবিল, শনগাঁও, নয়াপত্তন, ভান্ডারিগাঁওসহ মণিপুরি অধ্যুষিত ১৪টি গ্রামের ঘরে ঘরে দিন-রাত তাঁত চালানোর শব্দ শোনা যেত। এখন তাঁত চালিয়ে সুতা লাগিয়ে, মজুর খাটিয়ে তৈরি করা শাড়ি আর কেউ করতে চায় না। 

তাঁত শিল্পের কারিগর অরুণা দেবী জানান, মণিপুরি তাঁতে একখানা মোটামুটি মানের শাড়ি বুননে দুজন নারীর কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ দিন সময় লাগে। সুতাই লাগে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার। সব মিলিয়ে একটা শাড়ির খরচ পড়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে। পাইকারি ক্রেতারা সেটি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনে নেন। 

অন্যদিকে পলিয়েস্টার সুতা মিশিয়ে নকশা জাল করে মেশিনে উৎপাদিত শাড়িগুলো দেখতে তাদেরগুলোর মতো হলেও নিম্নমানের। ক্রেতার সামনে তাদের এক হাজার থেকে বারোশ টাকার শাড়ি মণিপুরিদের আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা মূল্যের শাড়িকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। এতে করে ক্রেতা মান এবং তারা বাজার হারাচ্ছেন। 

আদমপুর বাজারের মণিপরি হ্যাণ্ডিক্রাফট এর স্বত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ বলেন, মণিপুরি শাড়ি বাংলাদেশের গর্ব এবং সম্প্রতি এটি জিআই সনদ পেয়েছে। জিআই পণ্য নকল করে বিক্রি এবং বাজারজাত করা অপরাধ। এর বিরুদ্ধে সরকার যথাযথভাবে আইনপ্রয়োগ না করার কারণে বিভিন্ন স্থানে নকল ফ্যাক্টরি স্থাপন ও শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। ফলে মণিপুরি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন ধরে তাঁতশিল্পীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেকে অব্যাহত লোকসানে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁত শিল্পে নেমে এসেছে দুর্দিন। তাঁত শিল্প রক্ষায় উইভিং ফ্যাক্টরিসহ সকল নকল মণিপুরি শাড়ির কারখানা বন্ধ করে ভৌগোলিক সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে।

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

বৃহস্পতিবারের উল্লেখযোগ্য সাত সংবাদ
তরুণ, যুব ও মেধাবী ছাত্র সমাজকে রক্ষায় সুস্থ সংস্কৃতি জরুরি: রায়হান সিরাজী
৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ
ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘ডিটওয়াহ’
চালাক ছাত্রী

সর্বাধিক পঠিত

নাগেশ্বরীতে ১০ টাকার স্বাস্থ্য সেবা চালু
চাঁদপুর-২ আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা রয়েছে: তানভীর হুদা
দুই ট্রলারসহ সেন্টমার্টিনে ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি
গাজীপুরে রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী
এশিয়ান টাউনস্কেপ অ্যাওয়ার্ডসে সম্মাননা পেল রাজউক
সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close