ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে/ রাত দুপুরে অই/ ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে/ট্রেনের বাড়ি কই?/একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়/ মাঠ পেরুলেই বন।/ পুলের ওপর বাজনা বাজে/ ঝন ঝনাঝন ঝন। শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি যখন পড়ি তখনো ট্রেন দেখিনি। তবে পুলের ওপর সেই বাজনাকে অনুভব করতে পারছিলাম। ২০১২ সালে প্রথমবার যখন ট্রেনে উঠি সবার আগে এই কবিতাটাই মনে পড়ছিল। ঢাকা থেকে রাজশাহী যাচ্ছিলাম, ট্রেনটি টঙ্গি রেলব্রিজে ওঠার পর তার আওয়াজ আমাকে ১২ বছর আগের এক ক্লাসরুমে নিয়ে হাজির করেছিল।
২৩ অক্টোবর কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। হেমন্তের এই কবি ১৯২৯ সালে পুরান ঢাকার মাহুতটুলির নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার এই কবি নাগরিক কবি হিসেবেই সুপরিচত। দশক বিবেচনায় তিনি পঞ্চাশ দশকের কবি, তিনি কবিতায় মিথের ব্যবহারে যেমন বৈশ্বিক তেমনি আবার স্থানিকও তার প্রচুর কবিতায় ঢাকার জীবন যাপনকে খুঁজে পাওয়া যাবে। ঢাকা শহরের পার্ক থেকে ফুটপাত হয়ে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত সবই প্রায় বাক্সময় হয়ে উঠেছে তার লেখা পত্রে। পুরান ঢাকার অলিগলি আর জীবনের কথা না-হয় বাইরেও তার কাব্যভাষার আটপৌরে চলনস্বভাব আর প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তার এ ভাষা তাকে ঢাকার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছে।
কবি জীবনানন্দ দাশের নগর ও নিসর্গ চেতনায় বিবাদ ছিল, শামসুর রাহমানের তা নেই। নগরজীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণের শক্তি তার তৈরি হয়েছিল জন্ম থেকেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এক অনুকরণীয় কাব্যভাষা বা বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি, যা সহজবোধ্য এবং যাতে বিবরণ বা স্বীকারোক্তির ভেতর দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত মানস বা ‘ইথোস’কে ধরা যায়।
সাহিত্যে স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন।
‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা নেন। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কেকে/এমএ