সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫,
৪ কার্তিক ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মাউশির জরুরি সতর্কতা      আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে ইসি      আজ থেকে আমরণ অনশনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা      ৪৫ ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর যুদ্ধবিরতি পুনঃকার্যকরের ঘোষণা ইসরায়েলের      বকুলে জিম্মি ছাত্রদল      জবি ছাত্রদল নেতাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, দুইজন শনাক্ত      জুলাইয়ের চেতনার কথা বলে ওরা দেশটাকে সংকটের মুখে ফেলেছে : নুর      
বাতিঘর
সাহিত্যপ্রেমী শিক্ষক ও মানবিক আলোকবর্তিকা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: সোমবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:৫১ এএম
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিল্পসমালোচক। বহুমাত্রিক মানুষ হিসেবে তিনি প্রজ্ঞা, মানবিকতা ও সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। সিলেটে জন্মগ্রহণ করা এ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বই ও সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ পরিবেশে। তার বাবা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম ও মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন শিক্ষানুরাগী পরিবারে সন্তান।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ১৯৭৪ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার পেশাগত জীবনের সূচনা। টানা ৪৩ বছর শিক্ষকতা শেষে ২০১৭ সালে অবসর নেন এবং ২০২৩ সালের আগস্টে তাকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল অসাধারণ। শিক্ষার্থীরা তাকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘এসএমআই স্যার’ যিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার উৎস, জ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক, এবং সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের সেতুবন্ধ গড়তে পারদর্শী। তার ক্লাস শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয়, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জীবনের পাঠে ভরপুর ছিল।

সত্তরের দশকে তিনি গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় একটি গল্পের মাধ্যমে। তবে পরে দীর্ঘ দেড় দশকের বিরতি নেন। আশির দশকের শেষ দিকে, ১৯৮৯ সালে ‘বিচিন্তা’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় নতুন গল্প প্রকাশের মাধ্যমে তিনি আবার সাহিত্যে ফিরে আসেন আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি প্রথাগত গল্পধারার বাইরে গিয়ে লিখেছেন এক নতুন শৈলীতে, যেখানে জাদুবাস্তবতা ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা মিলেমিশে এক গভীর মানবিক সত্যের সৃষ্টি করেছে।

তার গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৪), থাকা না থাকার গল্প (১৯৯৫), কাচ ভাঙা রাতের গল্প (১৯৯৮), অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প (২০০১), প্রেম ও প্রার্থনার গল্প (২০০৫) প্রভৃতি। উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আধখানা মানুষ্য, দিনরাত্রিগুলি, তিন পর্বের জীবন, কানাগলির মানুষেরা ইত্যাদি। প্রবন্ধ ও গবেষণার ক্ষেত্রে তার নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৬), কতিপয় প্রবন্ধ (১৯৯২) এবং রবীন্দ্রানাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ উল্লেখযোগ্য।

সাহিত্য সমালোচক ও শিল্প-চিন্তক হিসেবেও তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ ও অনন্য। চিত্রকলা ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে তার গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘ছবির ভাষা মুখের ভাষার মতো নয়, কিন্তু তার নীরবতাই তার গভীরতম প্রকাশ।’ শিল্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে একজন ব্যতিক্রমী চিত্র সমালোচক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দেয়।

তিনি ছিলেন বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের দুই ধারার মধ্যবর্তী সেতুবন্ধ। গল্পকার মঈনুল আহসান সাবের যেমন বলেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে জাদু বাস্তবতা যখন তেমন পরিচিত ছিল না, তখনই মনজুরুল ইসলাম সেটি চর্চা শুরু করেন।’ তার লেখায় জীবনের কঠোর বাস্তবতা আসে সহজ, সাবলীল ভাষায়; কোথাও আত্মপ্রদর্শনের অহংকার নেই বরং রয়েছে মানবজীবনের নিঃশব্দ বেদনা ও সৌন্দর্যের সূক্ষ্ম উপলব্ধি।

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়া পেয়েছেন প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল বই পুরস্কার (২০০৫), কাগজ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৬) এবং কাজী মাহবুবুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার (২০১৬)।

তার সহকর্মী ও বন্ধুদের মতে, ব্যক্তি হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন অসাধারণ নম্র, বিনয়ী ও হৃদয়বান। কারো প্রতি অবজ্ঞা নয়, বরং আন্তরিক স্নেহ ও সম্মান প্রদর্শনই ছিল তার চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। মঈনুল আহসান সাবের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ‘তিনি মানুষকে মূল্য দিতে জানতেন, কখনো কাউকে ছোট করে দেখিনি।’

একজন সত্যিকারের শিক্ষক, যিনি ক্লাসরুমে যেমন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, তেমনি সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তার প্রস্থান বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে জ্ঞানের আলো, সৃজনশীলতার শক্তি ও মানবিক মূল্যবোধ একসঙ্গে ধারণ করা যায়।


শৈশব ও শিক্ষাজীবন
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ আমীরুল ইসলাম এবং মাতা রাবেয়া খাতুন। শৈশব থেকেই তিনি মেধাবী ও মননশীল ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৭১ সালে স্নাতক এবং ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি কানাডায় যান এবং ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইয়েটস-এর কবিতায় ইমানুয়েল সুইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব’বিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। 

কর্মজীবন
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষ্ঠা ও সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপনা করেন এবং শিক্ষকতা, গবেষণা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখেন। ২০১৭ সালের জুন মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক পদে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পরও শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগ অটুট থাকে; তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং সেখানে তরুণ প্রজন্মের জ্ঞানচর্চায় নিজেকে নিবেদিত রাখেন। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার দীর্ঘদিনের একাডেমিক অবদান ও কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক’ উপাধিতে ভূষিত করে।

লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক সমাদৃত
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষক হিসেবে যতই পরিচিতি পেয়েছিলেন, তার তুলনায় তিনি লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে আরো ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেন। শিক্ষাবিদ হিসেবের বাইরে তিনি বাংলা সাহিত্য ও মুক্তচিন্তার জগতে সক্রিয় ছিলেন; একজন গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং লেখক হিসেবে তার অবদানও সমান প্রশংসনীয়। সত্তরের দশকে তিনি বাংলার সাহিত্যে প্রবেশ করেন, যদিও এরপর দেড় দশকের একটি দীর্ঘ স্বেচ্ছাবিরতি নেন।

আশির দশকে তিনি আবার সাহিত্যজগতে সক্রিয় হন, এবার ভিন্ন রূপে। বিশেষত গল্প লেখা তার প্রধান মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। সাহিত্যিক ও বন্ধু মহলে বলা হয়, প্রথাগত গল্পধারার বাইরে গিয়ে তিনি এক নতুন শৈলীতে লিখতে শুরু করেন। তার গল্পের ভাষা সহজ, সাবলীল ও পাঠকবান্ধব। কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরও উল্লেখ করেছেন, তার লেখায় পাঠকপ্রিয়তা সর্বদা বিরাজমান। কোনো নির্দিষ্ট দশকের অন্তর্গত না হলেও, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা গল্প সাহিত্যের প্রথম সারির একজন স্বীকৃত লেখক হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।

সাহিত্য জীবন
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তার সাহিত্যচর্চা বহু ধারায় বিস্তৃত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা ও নন্দনতত্ত্ব সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজস্ব চিন্তা, শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।

তার গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বনির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৪), থাকা না থাকার গল্প (১৯৯৫), কাচ ভাঙা রাতের গল্প (১৯৯৮), অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প (২০০১) এবং প্রেম ও প্রার্থনার গল্প (২০০৫)। এ ছাড়া সুখদুঃখের গল্প ও বেলা অবেলার গল্প তার গল্পবলার গভীর সংবেদনশীলতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন বহন করে।


উপন্যাস রচনাতেও তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো আধখানা মানুষ্য (২০০৬), দিনরাত্রিগুলি, আজগুবি রাত, তিন পর্বের জীবন, যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক (ব্রাত্য রাইসুর সহযোগে), এবং কানাগলির মানুষেরা। এসব উপন্যাসে তিনি আধুনিক মানুষের একাকিত্ব, যোগাযোগহীনতা, অস্তিত্ব সংকট ও সমাজবাস্তবতার জটিলতা তুলে ধরেছেন এক অনন্য সাহিত্যভাষায়।

প্রবন্ধ ও গবেষণার ক্ষেত্রেও তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৬) এবং কতিপয় প্রবন্ধ (১৯৯২) গ্রন্থ দুটি তার গভীর তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া অলস দিনের হাওয়া, মোহাম্মদ কিবরিয়া এবং রবীন্দ্রনাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ (সুবীর চৌধুরীর সহযোগে) গ্রন্থে তিনি শিল্প, সাহিত্য ও দর্শনের সংযোগ নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে চিন্তার গভীরতা, নন্দনচেতনা ও ভাষার কাব্যিক ঔজ্জ্বল্যের সমন্বয়ে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টি করেছেন।

প্রখর চিত্র সমালোচক
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শুধু কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক বা শিক্ষক হিসেবেই নন, বরং একজন প্রখর চিত্র সমালোচক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি চিত্রকলার জগতে গভীর অনুরাগ ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক পত্রিকা ও বিশেষ গ্রন্থে তার লেখা চিত্রকলাসংক্রান্ত প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে শিল্প সম্পর্কে তার সূক্ষ্ম রুচি ও বিশ্লেষণী দৃষ্টি।


ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘মনজুরুল ইসলাম ছিলেন গভীর শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ চিত্রকলার প্রতি তার অনুরাগ ছিল প্রবল।’ এই অনুরাগের প্রতিফলন দেখা যায় তার কালি ও কলম সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখাগুলোতে, যেখানে তিনি লিখেছিলেন ‘ছবির ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট বাক্যবিন্যাস নেই, কোনো শব্দভান্ডারও নেই; তবু আমরা ছবির ভাষা বুঝি এটাই তার বিস্ময়।’

ঢাকার বিভিন্ন আর্ট গ্যালারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা প্রদর্শনীতে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। লেখক মঈনুল আহসান সাবের জানান, ‘১৯৯৬ সালে আমরা দু’জন একই বছরে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলাম। তখন তার যে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল তা ছিল নন্দনতত্ত্ব নিয়ে। অ্যাস্থেটিকসবিষয়ক চিন্তা-ভাবনা তাকে চিত্রকলা ও সমালোচনার জগতে গভীরভাবে টেনে নিয়েছিল।’

বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, যিনি তার চার দশকের বন্ধু, স্মরণ করেছেন, ‘মনজুরুল ভাই শিল্পের এক রূপের সঙ্গে আরেক রূপের সংযোগ স্থাপন করতেন। বিমূর্ত শিল্পকেও তিনি সাহিত্যের ভাষায় অনন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন।’

এইভাবেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একাধারে সাহিত্য ও শিল্প দুই জগতের সেতুবন্ধ রচনা করে গেছেন, যেখানে শব্দ ও রং মিলেমিশে গড়ে তুলেছে তার বহুমাত্রিক সৃজনজীবন।

শিক্ষা ও শিক্ষকতা দর্শন
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক আলোকিত শিক্ষক, যিনি শিক্ষা ও শিক্ষকতাকে শুধু পেশা নয়, বরং মানবিক দায়িত্ব ও নৈতিক সাধনা হিসেবে দেখতেন। তার শিক্ষা-দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল মানবতা, নৈতিকতা, সৃজনশীল চিন্তা ও মুক্তবোধের বিকাশ। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার লক্ষ্য শুধু তথ্য বা ডিগ্রি অর্জন নয়; বরং শিক্ষার্থীর অন্তরে জ্ঞান, সৌন্দর্য ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা।

শ্রেণিকক্ষে তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা প্রচলিত পাঠদানের সীমা ছাড়িয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের ভাবতে, প্রশ্ন করতে ও নিজের মতো করে পৃথিবীকে বুঝতে উৎসাহ দিতেন। তার ক্লাসে বইয়ের জ্ঞান মিলত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে। তিনি বারবার বলতেন, ‘একজন ভালো শিক্ষক সেই, যিনি নিজেও আজীবন শিক্ষার্থী।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি নিজে পড়তেন, গবেষণা করতেন, আর নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতেন চিন্তার স্বাধীনতায়।

তার শিক্ষকতা ছিল ভালোবাসা, যুক্তি ও নৈতিকতার মিশ্রণে গড়া এক প্রক্রিয়া। তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাতেন ভালো মানুষ হওয়াই শিক্ষার প্রথম শর্ত। তার শিক্ষা-দর্শনে জ্ঞান কেবল তথ্য নয়, বরং নৈতিক শক্তি, যা মানুষকে সমাজ ও নিজের প্রতি দায়বদ্ধ করে তোলে। তাই অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষকতা কেবল শ্রেণিকক্ষের সীমায় নয়, বরং মনন, প্রজ্ঞা ও মানবিকতার এক দীপ্ত যাত্রায় পরিণত হয়েছিল।


পুরস্কার ও সম্মাননা
সাহিত্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার সাহিত্যকর্মের গভীরতা, মৌলিকতা ও সমাজচেতনার জন্য তিনি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক-এ ভূষিত করে। এসব স্বীকৃতি তার সাহিত্য, গবেষণা ও একাডেমিক অবদানের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতার প্রতিফলন বহন করে।

প্রয়াণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন)। তিনি ১০ অক্টোবর বিকাল ৫টায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। গত ৩ অক্টোবর রাজধানীর ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)-এ যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চালক ও এক পথচারীর সহায়তায় তাকে নিকটস্থ এক হাসপাতালে নেওয়া হয় পরে তাকে থেকে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও পরবর্তীতে আবার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকেরা লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর তার মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নেওয়া হলে সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী ও শুভানুধ্যায়ীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ জোহর তার জানাজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। তাকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সূত্র : উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন

কেকে/ এমএস
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মাউশির জরুরি সতর্কতা
কাউখালীতে গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যু, গ্রেফতার ১
সাভারে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত গ্রেফতার
টঙ্গীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কলেজ ছাত্র খুন
গজারিয়ায় দুস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে সহায়তা বিতরণ

সর্বাধিক পঠিত

পুত্রবধূর হাতে শাশুড়ির মর্মান্তিক মৃত্যু
শ্রীমঙ্গলে দুই প্রতিষ্ঠানকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা
মৌলভীবাজারে অপরিকল্পিত সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে মানববন্ধন
জবি ছাত্রদল নেতাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, দুইজন শনাক্ত
স্বামী রেখে একের পর এক পরকীয়ায় জড়ান মার্জিয়া

বাতিঘর- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close