বদরুদ্দীন উমর ছিলেন বাংলাদেশের একজন মুক্তিকামী চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইসলামী চিন্তা থেকে প্রভাবিত হয়ে শিক্ষাজীবনের পর মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে নিজেকে স্থাপন করেন। বদরুদ্দীন উমর পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’সহ বহু প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
বদরুদ্দীন উমর : চিন্তা, জীবন ও অবদান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে বদরুদ্দীন উমর একটি অনন্য নাম। তিনি শুধু একজন রাজনীতিক নন, বরং একজন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, গবেষক, লেখক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাবিদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো মূলধারার রাজনীতির ক্ষমতার আসনে আসীন হননি, তবে তার লেখা, সংগঠন এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতি ও বামপন্থি আন্দোলনের বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ, ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি তার অটল নিষ্ঠা বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
তিনি স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এবং ১৯৭০-এর দশকে যে জুলাই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তাকে উপমহাদেশের একটি অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং একজন নিরলস সংগ্রামী, যিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তার অবদান গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ।
বদরুদ্দীন উমর
বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম ছিলেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫০ সালে উমর পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে। পারিবারিক প্রভাবেই উমরের শৈশব-কৈশোরের চিন্তায় ইসলামি আদর্শের প্রভাব দেখা যায়। তিনি এক সময় ‘তমুদ্দিন মজলিস’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (১৯৫৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৫) সম্পন্ন করার পর বদরুদ্দীন উমর উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৯৬১ সালে পিপিই (ফিলোসফি, পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময় পশ্চিমা রাজনৈতিক তত্ত্ব, বিশেষ করে মার্ক্সবাদ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ফলে ইসলামি ভাবধারা থেকে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে মার্ক্সবাদে রূপান্তরিত হয়।
উমরের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি ও লেখালেখির মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন।
বদরুদ্দীন উমর মার্ক্সবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক গণশক্তি’ সম্পাদনা করেন, যা ছিল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র। তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক শিবির ও জাতীয় মুক্তি পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার নিরলস আন্দোলন তাকে বামপন্থি রাজনীতির অন্যতম প্রধান মুখে পরিণত করে।
উমরের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল লেখনী। ষাটের দশকে প্রকাশিত তার তিনটি বই সম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭), সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯)। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিশ্লেষণে মৌলিক অবদান রাখে। এসব গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ‘সম্প্রদায়িকতা’ বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদকে প্রভাবিত করছে এবং কীভাবে একটি প্রগতিশীল জাতীয় আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া তার বিশাল গবেষণাকর্মের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি যেখানে ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তার লেখাগুলো একদিকে ইতিহাসচর্চা, অন্যদিকে বামপন্থি রাজনৈতিক তত্ত্বকে সুসংহত করার প্রয়াস।
বদরুদ্দীন উমর জীবনে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৪ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার এবং ২০২৫ সালে স্বাধীনতা পদক তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তার যুক্তি ছিল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার গ্রহণ করলে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়।
উমরের চিন্তায় ছিল যুক্তিনিষ্ঠতা, সাহসিকতা ও আপসহীনতা। ইসলামি ভাবধারার প্রাথমিক প্রভাব থেকে শুরু করে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক অবস্থান গ্রহণ পর্যন্ত তার চিন্তার যাত্রা ছিল দীর্ঘ ও জটিল। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির পক্ষে আজীবন আপসহীন থেকেছেন। তিনি ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশ নেননি, কিন্তু তার চিন্তা ও রচনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করেছে। বামপন্থি রাজনীতির ইতিহাসে এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় তার অবদান এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্ধমান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতনামা মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ এবং মাতা মাহমুদা আখতার মেহেরবানু বেগম। যদিও আবুল হাশিম সাম্যবাদী মতাদর্শের অনুসারী হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বদরুদ্দীন উমর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন বর্ধমানেই সম্পন্ন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫০ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৫৩ সালে দর্শনে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫৫ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ তাকে বিদেশে নিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফি, পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স (পিপিই) বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
বদরুদ্দীন উমর তার কর্মজীবনের সূচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগেই সেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। তবে ১৯৬৮ সালে তিনি স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন।
রাজনীতির ক্ষেত্রেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংস্কৃতি নামে একটি রাজনৈতিক সাময়িকী সম্পাদনা করেন।
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে বদরুদ্দীন উমর পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন এবং দ্রুতই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত বিশেষ কংগ্রেসের জন্য তাকেই প্রতিবেদন প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি
২০২১ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভিতে আসাদুজ্জামান নূর সঞ্চালিত একটি সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দীন উমর তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খোলাখুলি মত প্রকাশ করেন। তিনি জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহর প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি প্রশ্ন তোলেন, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং করুণাময় সত্তা দিয়ে পৃথিবীর মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কীভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? তার মতে, মানুষের দুর্ভোগকে ‘আল্লাহর পরীক্ষা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যৌক্তিক নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন একজন মা যদি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রবেশ করেন এবং ফিরে এসে দেখেন তার সন্তান মারা গেছে, তবে এ রকম ঘটনাকে পরীক্ষা বা খেলা হিসেবে ব্যাখ্যা করা মানবিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।
তিনি আরও বলেন, এই পরীক্ষার বোঝা সবসময় দরিদ্র মানুষের ওপরই বর্তায়, অথচ ধনীরা পার্থিব জীবনে সবকিছু পেয়ে যায়। গরিবদের ভাগ্য শুধু ‘বাকির খাতায়’ রেখে দেওয়া হয়। এই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারান বলে জানান।
ইসলামি ভাবধারা থেকে বামপন্থি রাজনীতি
বাংলাদেশের প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর জীবনের শুরুতে ইসলামি ভাবধারার প্রভাব পেলেও পরবর্তীতে বামপন্থি রাজনীতির পথে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে স্থাপন করেন। তার বাবা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মুসলিম লীগ নেতা। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে তিনি ‘খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছিল সমাজে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়ন। বাবার প্রভাবেই তরুণ বয়সে বদরুদ্দীন উমরের মধ্যে ইসলামি চিন্তার একটি প্রবল ধারা গড়ে ওঠে।
১৯৫০ সালে উমর পরিবার ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসে। ঢাকায় আসার পরও তিনি কিছুদিন তমুদ্দিন মজলিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে।
১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই (ফিলোসফি, পলিটিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স) ডিগ্রি অর্জন করেন। এ সময়েই তার মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক ভাবনার পূর্ণতা ঘটে।
শিক্ষকতা দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতায় স্থায়ী না হয়ে তিনি সক্রিয় রাজনীতির পথ বেছে নেন।
বদরুদ্দীন উমর এক সময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন।
২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন ‘জীবনের শুরুর দিকে বাবার প্রভাবে আমার মধ্যে এক ধরনের ইসলামি চিন্তার আচ্ছন্নতা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সেই ধারা বদলে গিয়ে মার্ক্সবাদী চিন্তায় আমি স্থির হই।’
রাজনৈতিক সক্রিয়তা
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির অনুসারী হিসেবে বদরুদ্দীন উমর ১৯৭০-এর দশক থেকে ঔপনিবেশিকবিরোধী প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এর আগে ১৯৬০-এর দশকে তিনি ধারাবাহিকভাবে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) এবং সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯)। এসব গ্রন্থে তিনি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র রাজনৈতিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রশ্নকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। তার এ কাজগুলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক অবদান রাখে।
১৯৬৯ সালে উমর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি দলের মুখপত্র সাপ্তাহিক গণশক্তি সম্পাদনা করেন। এ সাময়িকীতে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে নানা প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়।
বদরুদ্দীন উমর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন (বাংলাদেশ পিজেন্ট ফেডারেশন) এবং বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। লেখক শিবির ছিল দেশের প্রগতিশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রাচীনতম সংগঠন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলেরও সভাপতি ছিলেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ
বদরুদ্দীন উমর ছিলেন লেখক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তার রচিত গ্রন্থসমূহে প্রবন্ধ, গবেষণা, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক উঠে এসেছে।
বদরুদ্দীন উমরের প্রকাশিত বই
প্রথমদিকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭), সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৮) এবং পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি যা তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৭০, ১৯৭৬ ও ১৯৮১ সালে। কৃষক সমাজ, ঔপনিবেশিক শোষণ ও সামাজিক পরিবর্তনের বিশ্লেষণে তিনি রচনা করেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক (১৯৭২) ও বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষক আন্দোলন (১৯৮৬)। বিদ্যাসাগরের সামাজিক ভূমিকা ও উনিশ শতকের বাংলার প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ (১৯৭৩)।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায় তার বহু গ্রন্থে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা (১৯৭৪), যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ (১৯৭৪), বাংলাদেশে মার্কসবাদ (১৯৮১), বাংলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র (১৯৮২), বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কয়েকটি দিক (১৯৮৭), বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার (১৯৮৯), বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি (১৯৯৭), বাংলাদেশে ফ্যাসীবাদ (২০০১), বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র (২০০৩), আমার জীবন (২০০৪), আমার পিতা (২০০৫) এবং কার দিন বদল হলো (২০১০)। তার লেখায় সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতন্ত্র, শিক্ষা, দুর্নীতি, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ও দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতির নানা দিক গভীর বিশ্লেষণসহ স্থান পেয়েছে।
ইংরেজি ভাষাতেও তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh (১৯৭৩), Society and Politics in Pakistan (১৯৮০), Politics and Society in Bangladesh (১৯৮৭), Imperialism and General Crisis of the Bourgeoise in Bangladesh (১৯৮৬), Ges Language Movement in East Bengal(২০০১)। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার দুই খণ্ডের গবেষণাধর্মী কাজ Emergence of Bangladesh: Class Struggles in East Pakistan (১৯৪৭-১৯৫৮) (২০০৪, পুনর্মুদ্রণ ২০১৭ ও ২০২০) এবং Emergence of Bangladesh: Rise of Bengali Nationalism (১৯৫৮-১৯৭১) (২০০৬, পরবর্তীতে ২০২০ সালে পুনঃপ্রকাশিত)। এ দুটি গ্রন্থ বাংলাদেশের ইতিহাস, জাতীয়তাবাদ ও শ্রেণি-সংগ্রাম বিশ্লেষণে অসামান্য অবদান রেখেছে।
এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সুকান্ত সমগ্র (১৯৭০), ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল (দুই খণ্ড, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫), স্ট্যালিন প্রসঙ্গ (১৯৯০), পার্বত্য চট্টগ্রাম : নিপীড়ন ও সংগ্রাম (১৯৯৭) এবং নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গে (২০০৩)।
সম্মাননা
বদরুদ্দীন উমর তার কর্মজীবনে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননা লাভ করলেও তিনি সবকটিই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। একইভাবে ১৯৭৪ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ২০২৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক-এ ভূষিত করে। কিন্তু এই সম্মাননাও তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।
এক প্রেস বিবৃতিতে তিনি বলেন
‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা পুরস্কৃত করার চেষ্টা করেছে। আমি কখনোই সেগুলো গ্রহণ করিনি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। তবে তাদের দেওয়া এই পুরস্কারও গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
মৃত্যু
দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে বদরুদ্দীন উমর ২০২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুল রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা।