বাংলাদেশের জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা লেখক রকিব হাসান মারা গেছেন। ১৫ অক্টোবর ২০২৫ রাজধানীর একটি হাসপাতালে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার জীবনাবসান হয়। নব্বই দশকের তরুইরাই জানে এই তার মৃত্যর খবর তাদের হৃদয় কতটা নাড়া দিয়েছে। তার জন্ম ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর, কুমিল্লায়। বাবার চাকরিসূত্রে শৈশব কেটেছে ফেনীতে। সেখানে স্কুলজীবন শেষ করে ভর্তি হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পড়াশোনা শেষে বিভিন্ন চাকরিতে যুক্ত হলেও বাঁধাধরা জীবনে মন বসেনি ফলে থিতু হন লেখালেখিতে। সেবা প্রকাশনী থেকে তার লেখকজীবনের সূচনা। পাশাপাশি সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন ‘রহস্যপত্রিকা’য়।
প্রথম দিকে বিশ্বসেরা ক্ল্যাসিক বই অনুবাদ করেছেন। এরপর লিখে গেছেন ‘টারজান’, ‘গোয়েন্দা রাজু’, ‘আরব্য রজনী’, ‘রেজা-সুজা’ সিরিজসহ চার শতাধিক জনপ্রিয় বই। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজ বা কিশোর, মুসা ও রবিনের মতো চরিত্রগুলোর স্রষ্টা হিসেবে। ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজটি বাংলাদেশের অসংখ্য পাঠকের কৈশোরের সঙ্গী। ফলে পাঠকের কাছে রকিব হাসান শুধু একজন লেখক নন, কয়েক প্রজন্মের ভালোবাসার মানুষ। আর আমাদের কাছে রকিব হাসান ছিলেন বিমূর্ত এক জাদুকর। তার মুখ, কণ্ঠস্বর—কোনোটাই আমরা সচরাচর দেখিনি বা শুনিনি। তবুও তিনি ছিলেন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ। কারণ আমাদের জীবনের এক বিশাল অংশজুড়ে তার সৃষ্টি ছিল চারপাশে—পড়ার টেবিলে, স্কুলের ব্যাগে, বালিশের পাশে।
রকিব হাসানকে আমরা মূলত ‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা হিসেবে জানলেও, তার সাহিত্যকীর্তি ছিল সুদূর বিস্তৃত। তিনি এই সিরিজেরই প্রায় ১৬০টি বই রচনা করেছেন। এ ছাড়া তিনি কমপক্ষে ৩০টি বই অনুবাদ করেছেন। মূলত স্বনামে লেখালেখি করলেও, তিনি নানা ছদ্মনামেও ছিলেন সক্রিয়—
জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে লিখেছেন সেবা প্রকাশনীর জনপ্রিয় ‘রোমহর্ষক’ সিরিজ।
আবু সাঈদ ছদ্মনামে তিনি লিখেছেন ‘গোয়েন্দা রাজু’ সিরিজ।
শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে তিনি জুল ভার্নের মতো ক্লাসিক লেখকদের বই অনুবাদ করেছেন।
তার স্বনামে প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল অনুবাদগ্রন্থ—‘ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা’। এরপর তিনি এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেলের মতো বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বই বাংলায় অনুবাদ করে পাঠকের হাতে তুলে দেন। মহাক্লাসিক ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ এবং এডগার রাইস বারোজের ‘টারজান’ সিরিজ তার অনুবাদকর্মের অন্যতম সংযোজন। বিশেষ করে, তার হাত ধরেই বাংলাদেশে ওয়েস্টার্ন ঘরানার গল্প বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে, যেখানে বিদেশি মরুভূমি, বন্দুকের শব্দ আর ন্যায়ের জন্য লড়াই আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের অংশ হয়ে উঠত। তার অনুবাদ ছিল কেবল ভাষান্তর নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক রূপান্তর—যা এক নতুন পাঠকপ্রজন্ম তৈরি করেছিল।
রকিব হাসানের মৃত্যু নব্বই দশকের প্রজন্মের জন্য এক নস্টালজিয়ার ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। এই প্রজন্ম মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়ার ঝলমলে বিভ্রমহীন এক সময়ে বেড়ে উঠেছিল। তাদের বিকালের ঠিকানা ছিল বইয়ের দোকান, আর টিফিনের টাকা জমানো হতো নতুন ভলিউম কেনার জন্য। বইয়ের পাতলা নিউজপ্রিন্টে ছাপা ক্ষুদ্র অক্ষর আর টর্চলাইটের আলোয় রাত জেগে বই শেষ করার স্মৃতি—এগুলোই নব্বইয়ের দশকের এক সামষ্টিক অভিজ্ঞতা।
সেই সময়টায় সীমিত কনটেন্টে মানুষ একই সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছিল। তাই রকিব হাসানের প্রয়াণে তারা ব্যক্তিগত দুঃখের চেয়েও বেশি অনুভব করছে এক যৌথ আবেগপূর্ণ নস্টালজিয়া। এ শোক যেন কেবল একজন লেখকের জন্য নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া এক সরল শৈশবকে বিদায় জানানোর অনুভূতি।
বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে যখন মনোযোগ কমে গেছে, এবং বিনোদন ও আবেগ ভাগাভাগি একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছে, রকিব হাসানের মৃত্যু যেন নব্বই দশককে সিলগালা করে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেয়। এ যেন ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়’—এই চিরন্তন সত্যের প্রতিফলন।
আজ আমরা যারা নব্বই দশকের সন্তান, যারা বইয়ের ঘ্রাণে বড় হয়েছি, তারা বুঝতে পারছি যে আমাদের শৈশবের চেনা মুখগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। রকিব হাসানের মৃত্যুসংবাদ শুনে মনে হলো—এইবার হয়তো সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছি আমরা। তবে রকিব হাসান কি সত্যিই চলে গেলেন? না। তিনি একটি গোটা প্রজন্মের হৃদয়ে সিংহাসনে আরোহণ করে রাজার ন্যায় থেকে গেলেন। তার সৃষ্টি তাকে অমর করেছে। তিনি সেই লেখক, যিনি আমাদের কিশোর বয়সে সাহস শিখিয়েছেন, জীবনের প্রথম উত্তেজনা চিনিয়েছেন, বইয়ের পাতায় বিশ্বভ্রমণ করিয়েছেন। তার কিশোরের দৃঢ়তা, মুসার আচমকা সাহস আর রবিনের শান্ত বুদ্ধিদীপ্ততা আমাদের শিখিয়েছে যুক্তি, সাহস, আর বন্ধুত্বের মানে।
আজ সেই প্রজন্ম বাবা-মা হয়েছে, আর তাদের সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছে সেই একই ‘তিন গোয়েন্দা’। যখন নতুন প্রজন্ম সেই বইয়ের পাতায় ডুব দেবে, যখন কেউ হেসে বলবে ‘খাইসে!’, তখনো কোথাও রয়ে যাবেন রকিব হাসান। বাংলা অক্ষরে চিরকাল জ্বলজ্বল করবে তিনটি নাম—তিন গোয়েন্দা, সেবা প্রকাশনী, আর তার নিচে স্বর্ণাক্ষরে—রকিব হাসান।
তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন—আমাদের পাঠকমনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। প্রতিবার যখনই কোনো পুরোনো প্রচ্ছদে আঙুল রাখা হবে, তখনই রকিব হাসান আবার ফিরে আসবেন—অক্ষরে, কল্পনায়, ন্যবাদ, রকিব হাসান স্যার—আমাদের ছোটবেলাকে এত উজ্জ্বল করে তোলার জন্য, আমাদের কল্পনার রাজ্যকে এমন বিশাল অবমুক্ত করে দেওয়ার জন্য। আপনার শব্দের আলো নিভে যাবে না কোনোদিন। বেচে থাকবেন আমাদের ভালোবাসায়।
কেকে/এজে