জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের জন্য বরাদ্দ ৬৬৭ বস্তা চাল বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। ডিলারের গুদাম থেকে বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজিত জনতা চাল আটক করে স্থানীয় প্রশাসনকে খবর দেয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিনজনকে ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা ও জব্দকৃত চাল এতিমখানায় বিতরণ করা হয়।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকালে উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের ঝামুটপুর চান্দাইর দাখিল মাদ্রাসার পাশে একটি গুদাম থেকে মাত্রাই বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় উত্তেজিত জনতা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর ৬৬৭ বস্তা চাল আটক করেছে।
উত্তেজিত জনতা চাল আটকের বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানান। পরে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ঘটনাস্থলে গিয়ে ডিলার আশরাফ আলী, মাত্রাই বাজারের চাল ব্যবসায়ী আলী আহম্মেদ ও হাতিয়র বাজারের চাল ব্যবসায়ী সোহরাব আলীকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। সাথে চালও জব্দ করেন। সরকারি চাল বিক্রি ও ক্রয়ের ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ডিলার আশরাফ আলীকে ১০ হাজার টাকা, চাল ক্রেতা সোহরাব আলীকে ১৫ হাজার টাকা ও আলী আহম্মেদকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পাশাপাশি জব্দকৃত চালগুলো এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল থেকে আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নে সুবিধাভোগীদের মাঝে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর চাল বিতরণ করা হয়েছে। আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আকবরের ছোট ভাই আশরাফ আলী ডিলার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে চাল বিতরণ করে আসছেন। তিনি সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণের জন্য গত মঙ্গলবার স্থানীয় খাদ্য গুদাম থেকে চালগুলো উত্তোলন করে ঝামুটপুর চান্দাইর দাখিল মাদ্রাসার পাশে একটি গুদামে সংরক্ষণ করেন। বুধবার ডিলার আশরাফ আলী, চাল ব্যবসায়ী আলী আহম্মেদ ও সোহরাব মিলে সুবিধাভোগীদেরকে ডেকে ৩০ কেজি চালের পরিবর্তে ৯০০-৯৫০ টাকা করে ধরিয়ে দেন। তবে সুবিধাভোগীদের চাল ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো নিয়ম নেই। তারপরও ডিলার ও দুই ব্যবসায়ী মিলে এসব সুবিধাভোগীদের চাল স্বল্প মুল্যে কিনেন এবং প্রকাশ্যে বৃহস্পতিবার সকালে নিয়ে যান। চালগুলো ডিলারের গুদাম থেকে ব্যবসায়ীদের গুদামে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা আটক করেন। এরপর তারা কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানান।
পরে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মাহমুদুন নবী ঘটনাস্থলে পৌছে ডিলার আশরাফ আলী এবং ব্যবসায়ী আলী আহম্মেদ ও সোহরাব আলীসহ চালগুলো জব্দ করে নিয়ে আসেন। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা আক্তার জাহান তার কার্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তিনজনকে মোট ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন এবং জব্দকৃত চালগুলো বিভিন্ন এতিমখানায় বিতরণ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের বোড়াই গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘বুধবার ডিলার আশরাফ আলী সুবিধাভোগীদের ডেকে নিয়ে চালের পরিবর্তে টাকা দিয়েছেন। অনেকেই চাল বিতরণের বিষয়ে কিছুই জানে না। বৃহস্পতিবারও চাল বিতরণের কথা ছিল, কিন্তু ডিলার সেই চালগুলো বিতরণ না করে অল্প করে টাকা দিচ্ছেন। ডিলারের গুদাম থেকে যখন ভ্যান যোগে চালগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আমিসহ বেশ কয়েকজন মিলে ভ্যানের পিছনে পিছনে গিয়ে মাত্রাই বাজারে আলী আহম্মদের গুদাম থেকে চালগুলো আটক করি এবং ইউএনও-কে খবর দেই।’
চালের পরিবর্তে টাকা পাওয়া সুবিধাভোগী বোড়াই গ্রামের মৃত মহির উদ্দিনের ছেলে ছফির উদ্দিন, একই গ্রামের লজির উদ্দিনের ছেলে আব্দুল হান্নান সহ অনেকেই জানান, এবার তারা চাল পাননি। ডিলার ৩০ কেজি চালের পরিবর্তে ৯০০ টাকা দিয়েছে। চাল নাকি বরাদ্দ নেই।
বোড়াই গ্রামের এনামুলের স্ত্রী মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘৩০ কেজি চালের টাকা নিয়ে আবার বাজার থেকে ৫৮ টাকা কেজি দরে ১৫ কেজি করে চাল ক্রয় করেছি। কেন যে বার বার গরিবের পেটে লাথি মারা হয়, এর বিচারও হয় না। আমি এই ডিলারের লাইন্সেস বাতিলের দাবি করছি।’
আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেদ বলেন, ‘আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চাল ঝামুটপুর ডিলারের গুদাম থেকেই সুবিধাভোগীদের মাঝে বিতরণ করার কথা, কিন্তু সেই চাল কেন মাত্রাই বা হাতিয়র বাজারে যাবে? চাল বিতরণের বিষয়ে ডিলার আশরাফ আলী আমাকে কিছুই জানায়নি।’
ডিলার আশরাফ আলী বলেন, ‘চালগুলো সুবিধাভোগীদের নিকট বিতরণের পর কেনা হয়েছে। চালের পরিবর্তে যে টাকা দেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক না। আমিসহ ব্যবসায়ীরা মিলেই চালগুলো কিনেছি। তারপরও আমাদের জরিমানা করা হয়েছে এবং চালগুলো জব্দ করেছে।’
মাহমুদুন নবী বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে ঘটনাস্থলে গিয়ে ডিলার ও দুই ব্যবসায়ীকে আটক করে নিয়ে আসা হয়েছে ও সাথে ২০ মেট্রিকটন চাল জব্দ করা হয়েছে। সরকারি চাল ক্রয়-বিক্রয়ের কোন সুযোগ নেই।’
শামিমা আক্তার জাহান বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন আইন ২০২৩ (৬) ধারা মোতাবেক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দুই ব্যবসায়ীকে ৬০ হাজার ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিরর ডিলার আশরাফ আলীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সাথে জব্দকৃত ২০ মেট্রিকটন চাল উপজেলার বেশ কয়েকটি এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।’
কেকে/ এমএ