বিকেলবেলায় এখনো মাঝে মাঝে ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট ঘুরে দেখেন ফিরোজা বেগম। দায়িত্বে নেই, তবু মানুষের পাশে থাকা যেন তাঁর স্বভাব হয়ে গেছে। যেখানেই কেউ বিপদে, সেখানেই হাজির হন তিনি। ফটিকছড়ির মানুষের কাছে এখনো তিনি ‘আমাদের ফিরোজা আপা’—স্নেহ, শ্রদ্ধা আর আস্থার এক নাম।
ফিরোজা টানা ৩৩ বছর জনপ্রতিনিধি ছিলেন, এমন ধারাবাহিক দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত দেশে খুব কমই আছে। তার বয়স এখন ৫৮ বছর। ইন্টারমিডিয়েটে পড়াকালীন সময়ে বিয়ে হয়েছিল তার। কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় সে সংসার টেকেনি। ফিরে আসেন বাপের বাড়ি—ফটিকছড়ির ধুরুং এলাকার নূর আহমদ সুফি বাড়িতে। জীবনটা তখন যেন থমকে গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় ফিরোজা বেগমের নতুন যাত্রা। সংসার ভাঙার আঘাতকে শক্তিতে রূপ দিয়ে তিনি ঠিক করেন, বাকি জীবন কাটাবেন মানুষের সেবা করে।
১৯৮৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরিতে যোগ দেন ফিরোজা। প্রথমে মাতৃকেন্দ্রের সম্পাদক, পরে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। মানুষের কষ্ট কাছ থেকে দেখে বুঝলেন, আসল পরিবর্তন আনতে হলে প্রশাসনের বাইরে গিয়ে জনগণের প্রতিনিধি হতে হবে। ১৯৯২ সালে ধুরুং ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে প্রথমবার প্রার্থী হন গোলাপ ফুল প্রতীকে। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে শুরু হয় তাঁর জনপ্রতিনিধিত্বের যাত্রা। এরপর একে একে চারবার ইউপি সদস্য এবং পরে ফটিকছড়ি পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তিনবার সংরক্ষিত কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
সর্বশেষ মেয়াদে সরকার পতনের পরে সকল কাউন্সিলরকে অব্যাহতি দেয়া হলে, এখন তিনি সাবেক কাউন্সিলর। কিন্তু এলাকার মানুষের কাছে এখনো বর্তমান সময়ের মতোই সক্রিয় তিনি। প্রত্যেক দিনের শেষে ভাইয়ের দোকানের অফিসে বসে এলাকার মানুষের খোঁজখবর নেন ফিরোজা বেগম। কার চিকিৎসা দরকার, কার সমস্যা প্রশাসনে জানাতে হবে, সবকিছুতেই পাশে থাকেন তিনি।
তার ভাই মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, জনগণের সেবা দিতে আপাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। যে কোনো দুর্যোগে, বিপদে বা আনন্দে তিনিই সবার আগে ছুটে যান।
রক্ষণশীল সমাজে একজন নারী পায়ে হেঁটে ওয়ার্ডের কাজ দেখা, রাস্তাঘাট তদারকি করা, সবকিছুই একসময় কৌতূহল ও তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। কিন্তু ফিরোজা এসবের পরোয়া করেননি। একাগ্রতা আর আত্মবিশ্বাসে কাজ করে গেছেন মানুষের জন্য। ফিরোজা জনপ্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি তিনি বহু সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এদিকে তিন মেয়াদে ফটিকছড়ি পৌরসভার প্যানেল মেয়র, ধুরুং কে.এম. টেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি, আনোয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, ফটিকছড়ি কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সভাপতি এবং ফটিকছড়ি ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য ছিলেন তিনি।
২০২৩ সালে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের আওতায় সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি উপজেলা পর্যায়ের জয়িতা সম্মাননা পান।
এত অর্জনের পরও সংসার না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুতাপ নেই ফিরোজা বেগমের। বরং তিনি বলেন, মাদার তেরেসা আর প্রিন্সেস ডায়ানাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। মানুষের জন্য কাজ করলেই আমি শান্তি পাই। যতদিন পারি, মানুষের পাশে থাকতে চাই।
১৯৯২ সাল থেকে ২০২৫। তিন দশকেরও বেশি সময় জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ফিরোজা বেগম। দায়িত্ব শেষ হলেও মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় তিনি এখনো জনপ্রতিনিধির মতোই প্রভাবশালী।
এক জীবনের লড়াই, ত্যাগ আর নিষ্ঠায় গড়া এই নারীর গল্প শুধু ফটিকছড়ির নয় পুরো দেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
কেকে/ আরআই