আমাদের প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাহমাতুললিল আলামীন বা সারাজাহানের জন্য রহমত। তাঁর জীবনাদর্শ ও ইতিহাস, সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সমগ্র মানবধারার জন্য আলোর মিনার হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। তার জীবনচরিত কেবল মুসলিমদের জন্যই অনুসরণযোগ্য নয়, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই মূল্যবান পাথেয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ও সামগ্রিতা একটি স্বীকৃত বিষয়। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে তাকে এমন পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনপ্রণালী দান করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যথার মলম, দুশ্চিন্তার চিকিৎসা, যাবতীয় সমস্যার সমাধান।
সিরাতে নববীর লেখকগণ তার সামগ্রিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন এবং তারা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন যে, মানব-জীবনের কোনো দিক ও পর্যায় এমন নেই, মানবতার কোনো শ্রেণি ও স্তর এমন নেই, যার রাহনুমায়ী ও দিকনির্দেশনা তার সামগ্রিক জীবন-সিরাতে নেই। ব্যবসা, কিষান, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক-চাকুরে, আবালবৃদ্ধবনিতা, উস্তাদ-শাগরেদ, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোনসহ মনুষ্যশ্রেণির কোনো শাখা এমন নেই, মানবতার কোনো সম্পর্ক-সূত্র এমন নেই, যার প্রতি দিকনির্দেশনার পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক যোগ্যতা ও কার্যকারিতা তার পবিত্র জীবনধারায় ছিল না। ইতিহাস প্রমাণ করে এজাতীয় সামগ্রিক শ্রেষ্ঠত্ব সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে একমাত্র মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনসত্তার মধ্যেই সুসমন্বয় ঘটেছে।
অপরদিকে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু মানবজাতিরই নবী নন; বরং তিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলেরও নবী। পৃথিবীর বৃক্ষলতা, পশু-পাখি সবকিছুই তাকে শ্রেষ্ঠ নবী বলে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে। তিনি সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। সমগ্র সৃষ্টিকুল সৃষ্টির সূচনা থেকে মহান আল্লাহর যেসব রহমত লাভ করেছে তা কেবল আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদৌলতেই লাভ করেছে। এজন্যই তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ বা জগতসমূহের জন্য রহমত। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে নবী! আমি তোমাকে জগতসমূহের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি’ (সূরা আম্বিয়া : আয়াত-১০৭)
আবার আমাদের সকলের রূহ যখন আলমে আরওয়াহে ছিল, আমরা যখন মাতৃগর্ভে সম্পূর্ণ অসহায় ছিলাম, এমনকি সকল নবী-রাসূলগণের রূহ যখন আলমে আরওয়াহে ছিল, সকল নবী-রাসূলগণ যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখনও আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ‘রহমত স্বরূপ’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহান আল্লাহ পাক যখন থেকেই ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হিসাবে মনোনীত করেছেন তখন থেকেই তিনি সকলের নবী, সকলের জন্য রহমত। তাই একথা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়তের সূচনা সৃষ্টির সূচনা থেকেই।
হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহপাক বলেছেন, ‘হে নবী! যদি তোমাকে প্রেরণ না করতাম তাহলে দুনিয়ার কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’ উক্ত হাদীসে কুদসী দ্বারা প্রমাণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুয়তের সূচনা সৃষ্টির সূচনা থেকেই। তিনি তাঁর জন্মের পূর্বেও নবী, আর তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্যই প্রেরিত হয়েছেন। বিশেষ কোনো গোত্র, সম্প্রদায় কিংবা নির্দিষ্টকালের জন্য তিনি আবির্ভূত হননি। যেমনটি পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণ হয়েছিলেন। তাঁর আবেদন সার্বজনীন ও সর্বকালীন।
আল কোরআনের বাণী, হে নবী! আপনি বলে দিন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহর রাসূল হয়ে প্রেরিত হয়েছি। সমগ্র আসমান ও জমিনে তাঁর রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং বিশ্বাস স্থাপন কর তাঁর উম্মী নবীর ওপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। তোমরা তাঁর অনুসরণ কর যাতে সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার। (সূরা আ‘রাফ: আয়াত ১৫৮)
তার জীবনের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে তার ব্যক্তিত্বের এই দিকটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী যে তার সমগ্র শিক্ষাধারা মানুষ ও মানবতার জন্য রহমত, নেয়ামত এবং অত্যন্ত কল্যাণজনক। এবং তার জীবন-দর্শন মানুষের মেজাজ ও স্বভাবের জন্য অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক।
মানুষের বিবেক, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে তার জীবনাদর্শের উপকার ও কার্যকারিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তার শিক্ষা ও দর্শন গভীরভাবে সবিস্তারে অধ্যয়ন করলে এই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেসব জিনিসই তার শরিয়তে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা মানবমণ্ডলীর জন্য ক্ষতিকর এবং মানুষের আখলাক ও আধ্যাত্মিকতা বিনাশী এবং স্বভাব-সংহারক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক এক হুকুম এবং এক এক সুন্নত নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে আন্দাজ করা যাবে যে, তিনি আমাদের জন্য খুঁজে খুঁজে এমন এমন বিষয়বস্তু নির্বাচন ও নির্ধারণ করেছেন এবং আমাদের গ্রহণ করার হুকুম দিয়েছেন, যা আমাদের জন্য সার্বিক বিবেচনায় সীমাহীন উপকারী ও কল্যাণকর এবং যার মধ্যে রয়েছে আত্মিক ও পার্থিক উপকারিতার সঙ্গে সঙ্গে বহুরকম বাহ্যিক ও জাগতিক উপকারিতা।
জ্ঞান-গবেষণার এই যুগে সুন্নতে নববী ও আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর যেসব গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে, তার চিত্তাকর্ষক ও বিস্ময়কর ফল ও ফসল আমাদের সামনে চলে এসেছে; সুন্নতের ব্যাপারে বিজ্ঞানের এই সত্যায়নের ফলে আমাদের মধ্যে বিস্ময় ও আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। অন্তরজুড়ে অন্যরকম এক প্রেরণা জন্ম নেয়। মেসওয়াক ও সুরমার সুন্নত থেকে নিয়ে খাওয়ার পর আঙুল চাটা পর্যন্ত প্রতিটি সুন্নতের ব্যাপারে এমন চিত্তার্কষক ও আনন্দময় উপকারিতা বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ আবিষ্কার করেছেন, যার ফলে মানুষের চিন্তা ও বিবেক বিস্ময়ের ঘোরে আবিষ্ট হয়ে পড়ে এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের মর্যাদা ও অবস্থান এবং তার সৌন্দর্য ও পবিত্রতার অনুভূতি আরও শাণিত ও সমৃদ্ধ হয়।
আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই, যেসব জিনিস আমরা ইত্তেবায়ে সুন্নত হিসাবে সওয়াবের আশায় আমল করি, সেসবের মাধ্যমে আমরা উপরিপাওনা হিসাবে দৈহিক ও আত্মিক উপকারও লাভ করে থাকি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি বাণী ও আমল অনুসরণের মধ্যে সওয়াব তো আছেই। এর ওপর থাকছে বাহ্যিক ও বাড়তি পাওনা হিসাবে দৈহিক ও আত্মিক বহুরকম উপকারিতা। অযু, মেসওয়াক, নামাজ, রোজা, জাকাত ছাড়াও পানি, পোশাক, খোশবু, সুরমা, জিকির, অজিফা, পশু-জবাই, রোগীর সেবা, বকরির দুধ, নখ কর্তন, পানি পরিষ্কার, প্রতিবেশীর অধিকার, ইখলাস ও মৃত্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য সুন্নতের ওপর পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিস্ময়করভাবে আমাদের সামনে সুন্নতের গুরুত্ব, প্রয়োজন ও উপকারিতা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যার প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা ঈমানের অংশ, যার আনুগত্য আল্লাহর মহব্বতের জামানত। এখন কি তিনি এতটুকু হকদার নন যে, আমরা তার প্রশংসা ও স্তুতির তারানার সঙ্গে, সিফত ও নেয়ামতের ঝর্নাধারার সঙ্গে তার এক একটি সুন্নতের ওপর আমল করব এবং নিজেদের পার্থিব ও জাগতিক উপকারিতার জন্য তার প্রতিটি কথা ও কর্ম ভাষা-সাহিত্যের সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে দিব।
আমাদের ওপর কি এই দায়িত্ব অর্পিত হয় না যে, এই মহান ব্যক্তিত্বের অবস্থাদি ও পরিচয় অমুসলিমদের মাঝেও পূর্ণরূপে ব্যক্ত করব এবং তার জীবনের এক একটি কথা নিয়ে গলিতে গলিতে, মহল্লায় মহল্লায় এবং শহরে শহরে ঘুরে ফিরব এবং ইতর-ভদ্র, অভিজাত-সাধারণ প্রত্যেকের কাছে এই সওদা পৌঁছে দিব যে, এই মহান ব্যক্তি বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের না এবং শুধু আমাদের জন্যও না, তিনি হলেন রাহমাতুললিল আলামিন বা সারা দুনিয়ার জন্য এবং সমগ্র মানুষ ও মানবতার জন্য রহমত।
অতএব আসুন আমরা মুসলিম উম্মাহ প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ ও আনুগত্য করি। আমাদের উপকারের জন্য, আমাদের দ্বীন ও ঈমানের জন্য, আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার জন্য। যার জীবনের প্রতিটি আমল অভিজ্ঞতা ও গবেষণার কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত এবং আধুনিক বিজ্ঞানও যাকে অবনত মস্তকে স্বীকৃতি ও সনদ প্রদান করেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রিয় নবীজীর আদর্শে আদর্শবান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
কেকে/ এমএস