ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। পরিবর্তিত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। গণমানুষের সেই স্বপ্নের দলিল হলো জুলাই সনদ।
‘জুলাই সনদ’ এ বছরের জুলাই মাসেই গৃহীত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে সময়সীমা পার হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ দুবার বাড়ানোর পর ৫ তারিখ রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সব দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পক্ষে সম্মত হয়েছে। নিশ্চিতভাবে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে জাতীয় ঐক্য তৈরিতে তাদের এ ভূমিকা প্রশংসনীয়।
নিশ্চিতভাবে এটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি। কিন্তু যেটি নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে সেটি হলো গণভোটের আয়োজন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য নির্বাচনের আগে গণভোট চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অপরদিকে বিএনপি, গণসংহতিসহ বেশ কয়েকটি দল চায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট হোক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, ‘সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে মিলিয়ে গণভোটে কোনো বাধা নেই। সনদে কী থাকবে তা জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকবে। এ রায় চূড়ান্ত হবে এবং আগামী সংসদ তা মেনে চলবে।’
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় গণভোট নিয়ে। গণভোটের এ প্রক্রিয়ায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন এখানে কোনো প্রস্তাবের সমর্থন ও অন্যটির বিরোধিতা করার সুস্পষ্ট মাধ্যম নেই। ফলে বিভাজনকে বৈধতা দেওয়ার একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ক্রিয়াশিল হতে পারে গণভোট। এর আগে আমরা দেখেছি যেমন ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ক্ষেত্রে সব দলের সমঝোতা ছিল এবং গণভোট ঐকমত্যকেই অনুমোদন দিয়েছিল। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না?’
এ সংশোধনীতে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু বর্তমানের ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর বিষয়গুলোতে ঐকমত্য নেই। নারী আসনের মতো একটি অগ্রগতিশীল বিষয় গণভোটে আটকে গেলে, সেটি ভবিষ্যতে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথকে আটকে দিয়ে পশ্চাৎপদ অবস্থান স্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
‘জুলাই সনদে’ স্বাক্ষর করা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফলে গণভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করলে তৈরি হতে পারে নতুন ধরণের সংকট। যুক্তরাজ্য যেভাবে গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, সেটি অচলাবস্থা ভাঙার পরিবর্তে আর বড় বিভাজন ডেকে এনেছে। বাংলাদেশের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এমন ঝুঁকি নেওয়া কতটুকু সমীচীন সেটি ভাববার বিষয়। গণভোট দিয়ে বিভক্তিকে বৈধতা দেওয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গড়ে উঠলে সেটি দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল বয়ে আনে।
আরেকটি ব্যাপার হলো দেশের এ রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে যেখানে জাতীয় নির্বাচন নিয়েই নানা শংসয় ও সংকট রয়েছে সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজনে ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় রাখা দরকার। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে পারে, তৈরি করতে পারে আস্থার সংকট। সেদিক বিবেচনা করলে জাতীয় নির্বাচনের দিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের আয়োজন করাই যুক্তিযুক্ত।
আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো স্পষ্ট করতে আগামী ৮ অক্টোবর বিকালে আবারো রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোকে নিয়ে বৈঠক বসবে ঐকমত্য কমিশন এবং ১৫ অক্টোবরের মধ্যে সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা সেখানে গণভোটকে কীভাবে ফলপ্রসূ করা যায় এবং নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজনের যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে সেগুলো বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিবে ঐকমত্য কমিশন। কোনো কার্যক্রমে যাতে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকে রাখতে হবে সজাগ দৃষ্টি।
কেকে/ এমএস