বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কেবল আর্থিক দুর্বলতা নয়, বরং সুশাসনের অভাব এবং কাঠামোগত ত্রুটিরই প্রতিফলন। ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ২৪.১৩ শতাংশে। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশই খারাপ ঋণ, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সঠিক নীতি ও নেতৃত্ব থাকলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের সংকট, সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন মাহমুদ ওসমান ইমাম। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় বক্তব্য দেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন, পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ও ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় (ইউএপি) ও জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেন যৌথভাবে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সংকটের ভয়াবহতা তুলে ধরে মাহমুদ ওসমান ইমাম জানান, ২০২৪ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মোট সংকটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৭৫ ট্রিলিয়ন টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঁচটি প্রধান উৎস থেকে এসেছে। এর মধ্যে ২,১১,৩৯১ কোটি টাকা হলো স্বীকৃত অ-কার্যকরী ঋণ। আরও ২,৭২,৮৫৬ কোটি টাকা পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণের আড়ালে লুকিয়ে আছে, যা কাগজে-কলমে ভালো দেখালেও প্রকৃতপক্ষে খেলাপি। এ ছাড়া অবলোপন করা হয়েছে ৭৫,৩৮৯ কোটি টাকা, যা আদায়ের সম্ভাবনা নেই ধরে নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশেষ হিসাবে থাকা ৩৯,২০৯ কোটি টাকা এবং আদালতের স্থগিতাদেশের অধীনে থাকা ৭৬,১৮৫ কোটি টাকার ঋণ, যা আদায় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ বিপুল পরিমাণ সংকটাপন্ন ঋণ দেশের উন্নয়নে এক বিরাট বাধা। এ অর্থ দিয়ে ২৩টি পদ্মা সেতু অথবা ১৪টি মেট্রোরেল প্রকল্প সহজেই নির্মাণ করা যেত।
তিনি বলেন, আর্থিক খাত সংস্কার জটিল ও ব্যয়বহুল। দেশে যেমন কয়েকটি ভালো ব্যাংক আছে, আবার জম্বি ব্যাংক আছে। এসব জম্বি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশের ওপরে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে মাহমুদ ওসমান ইমাম আরও বলেন, এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন পরিচালক বোর্ডে থাকতে পারবেন। বোর্ড সদস্যদের মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যানও মালিকপক্ষের বাইরের কেউ থাকা উচিত। এতে ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে কমেছে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে, টায়ার-১ মূলধন অনুপাতও ০.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক নিচে। এ দুর্বলতার কারণে ব্যাংকগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এ ছাড়া ‘হোয়াইট পেপার’ অনুযায়ী ১০টি ব্যাংককে ‘জম্বি’ বা দেউলিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো প্রযুক্তিগতভাবে প্রায় অচল এবং তারল্য সংকটে ভুগছে।
এই সংকটের মূল কারণ বহুমুখী। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ব্যাংকিং লাইসেন্স দেওয়া এবং বড় আকারের জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যার অধিকাংশই আদায় করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং দুর্বল ঋণ ব্যবস্থাপনা সংকটকে আরো গভীর করেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমত, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তাদের অবস্থা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে আলাদা পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব ব্যাংকের পুনরুজ্জীবনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সেগুলোকে বিলুপ্ত করতে হবে। অন্যদিকে, যেসব ব্যাংক দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোকে সরকার স্পন্সরড বেলআউট বা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আমানত সুরক্ষা স্কিমকে শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, ব্যাংক আইন সংশোধন করে পরিবারভিত্তিক পরিচালকের সংখ্যা সীমিত করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক, যেমন প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে কাজ করছে, যা প্রমাণ করে সঠিক নীতি ও নেতৃত্ব থাকলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, এস আলম একাই পুরো ব্যাংক খাত ধ্বংস করে দিয়েছেন। একজন মাত্র ব্যক্তি যেমন একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দিতে পারে। উল্টোভাবে এক-দুজন সৎ পরিচালকও একটি ব্যাংকের সফলতার জন্য যথেষ্ট।
তিনি বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা সমস্যাপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০টি। বিদেশি ব্যাংক বাদ দিয়ে স্থানীয় ব্যাংক রয়েছে ৫০টি। এর মধ্যে কমবেশি ৪০টি ব্যাংক মানসম্মত নয়। এগুলোর মধ্যে প্রায় ১৫টি ব্যাংককে বলা হচ্ছে একেবারে ‘জম্বি ব্যাংক’। এসব ব্যাংকের অর্ধেকেই সরাসরি লুটপাট হয়েছে।
মাসরুর আরেফিন বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার কথা বলা হয়েছে। ভালো ব্যাংকেও কেন এ নিয়ম মানতে হবে? নতুন খসড়ায় আরও বলা হয়, একটি পরিবার একটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রাখতে পারবে। তবে পরিবারের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়স্বজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবে দেশের ব্যাংক খাতে বড় লুটপাট হয়েছে বেনামি নামে, বৈধ শেয়ার মালিকানার কারণে নয়।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ব্যাংক খাতে সংকট এখনো কাটেনি। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২ ট্রিলিয়নে। ২০২৫ জুনের হিসেবে খেলাপি ঋণ আরো দেড় ট্রিলিয়ন বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ বিতরণ করা মোট ঋণের ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে; ফলে অনেক আমানতকারী প্রয়োজনের সময় টাকা তুলতে পারছেন না। যা ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সংকট।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হোসেন বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘হুইসেলব্লোয়িং’ নীতিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। একইভাবে রেটিং এজেন্সিগুলোর জবাবদিহি বাড়াতে হবে। বর্তমানে ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া, তারা আমানত ফেরত দিতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, রেটিং এজেন্সিগুলো কী বলেছিল? দুর্নীতি দমন কমিশন কী করেছে? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো কী বলছে? প্রায়ই শোনা যায়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা চাকরি হারানোর ভয়ে বাধ্য হয়ে অনিয়মে সায় দিয়েছেন।
সোহেল আর কে হোসেন আরো বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবেও তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো, যেগুলো বড় অনিয়মের জন্য দায়ী, সেগুলোর ওপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। শুধু পরিদর্শন নয়, অনিয়ম হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তাৎক্ষণিক ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।
কেকে/ এমএস