কমে যাচ্ছে সহনশীলতা, তুচ্ছ ঘটনায় মেজাজ হারাচ্ছে মানুষ। ফলে দেশজুড়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে হত্যাকাণ্ড। মানুষের জীবন এখন ঠুনকো একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কখন কে কী কারণে কাকে হত্যা করছে- সেটা এখন দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টা এমন পর্যায়ে এসেছে- মানুষ হত্যা যেন মামুলি ব্যাপার। কারো সঙ্গে মতের অমিল- ঘটছে হত্যাকাণ্ড। প্রেমের সম্পর্কে বাধা- ঘটছে হত্যাকাণ্ড। পারিবারিক ঝগড়া- ঘটছে হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়া ছিনতাই-ডাকাতি, আধিপত্য বিস্তার তো আছেই। কথায় কথায় হত্যা ছাড়া যেন আর কোনো সমাধান নেই।
গত কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা, ফরিদপুর, বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার ও নেত্রকোনায় একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, পুরোনো শত্রুতা কিংবা ডাকাতির ছদ্মবেশে সংঘটিত হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ড। তবে এসব ঘটনায় একটা বিষয় পরিষ্কার যে- অপরাধীরা খোলামেলাভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। যেন আইনের প্রতি তাদের কোনো ভয় নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা ও অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে না পারার কারণে খুনিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
টাঙ্গাইলে বিএনপি নেতার স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা : গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় বিএনপি নেতা আনিছুর রহমান উত্তমের স্ত্রী লিলি আক্তারকে মুখোশধারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। স্থানীয়রা বলেন, মগড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান উত্তমের বাড়ির পাশেই নিজেদের বিস্কুটের ফ্যাক্টরি রয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নামাজ শেষ করে উত্তম ফ্যাক্টরিতে যেতেন। মঙ্গলবার রাতে উত্তমের ফ্যাক্টরিতে যেতে দেরি হওয়ায় তাকে খুঁজতে স্ত্রী লিলি আক্তার সেখানে যান। এ সময় আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে লিলিকে কোপাতে থাকে। পরে তার চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে লিলিকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তারা আরো বলেন, ফ্যাক্টরির বাইরে দুজন দাঁড়িয়ে দিলেন, আর ভেতরে মুখ বাঁধা অবস্থায় একজন অস্ত্রধারী ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, মগড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে হত্যা করার উদ্দেশে তারা এসেছিল।
আদাবরে নিজ বাসায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন : রাজধানীর আদাবরে বাসায় ঢুকে রিপন ওরফে নিপুকে খুন করেছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। সেনাবাহিনীর অভিযানে তিনজন ধরা পড়লেও মূল হোতারা পালিয়েছে। জানা যায়, মাদক কারবার নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার ভোরে আদাবরের বাসায় ঢুকে রিপন ওরফে নিপুকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে কিশোর গ্যাং বেলচা মনির গ্রুপের সদস্যরা। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যার দিকে রিপনের মৃত্যু হয়।
ফরিদপুরে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে মামাকে হত্যা : ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ভাগনের হাতে খুন হয়েছেন মামা আফসার শেখ। পারিবারিক বিরোধের জেরে তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর নিহত আফসার শেখের ২ নাতি সুমন ফকির ও আবির কাজী বাড়ির পূর্ব পাশের বিলে গোসল করতে গিয়ে হাতাহাতি ও মারামারি করে। মারপিটের বিষয়ে জানতে রাত ১০টার দিকে ভাগনে ও ভগ্নীপতির কাছে জানতে চান নিহত আফসার শেখ। এসময় ভাগনে হাসান ফকির, জহুরুল ইসলামসহ তাদের লোকজন বাড়ি থেকে একটু অদূরে ডেকে নেয় মামা আফসারকে। সেখানে এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় কুপিয়ে জখম করে ফেলে যায় তারা। পরে নিহতের স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বগুড়ায় প্রবাসীর বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী-ছেলেকে হত্যা : বগুড়ার শিবগঞ্জে প্রবাসীর বাড়িতে ঢুকে মা-ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ঠিক কী কারণে এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটলো তা কেউই পরিষ্কার নয়। তবে এমন মর্মান্তিক ঘটনায় এলাকাজুড়ে নেমেছে শোকের ছায়া। আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মনে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুল্লাপুর বটতলা গ্রামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে হতবাক স্থানীয়রা। গত সোমবার গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা একটি প্রবাসীর বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী ও ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকারসহ মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। মঙ্গলবার সকালে বাড়ির ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় তাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনা ঘিরে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া ও আতঙ্ক। নিহতরা হলেন- সাদুল্লাপুর বটতলা গ্রামের কুয়েত প্রবাসী ইদ্রীদ আলীর স্ত্রী রানী বেগম (৩৮) এবং তাদের একমাত্র ছেলে ইমরান হোসেন (১৬)। ইমরান স্থানীয় স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিল। পরিবারে প্রবাসী বাবার রোজগারে মোটামুটি সচ্ছলতা থাকলেও মা-ছেলেকে হারিয়ে মুহূর্তেই ভেঙে পড়েছে পরিবার।
মাদারীপুরে কলেজছাত্রকে জনসমক্ষে কুপিয়ে হত্যা : মাদারীপুরের শিবচরে কলেজছাত্র রাকিব মাদবরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে শত মানুষের সামনে। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখনো কোনো আসামি ধরা পড়েনি। স্থানীয়রা জানান, শিবচর উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের চরশ্যামাইল গ্রামের আবুল কালাম সরদারের লোকজনের সঙ্গে নিহত রাকিব মাদবরের লোকজনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ৬ মে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের হামলায় আবুল কালাম সরদারের ছেলে ইবনে সামাদ নিহত হন। ইবনে সামাদ হত্যা মামলার আসামি রাকিব সম্প্রতি জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে এলাকায় আসেন। রোববার রাত আটটার দিকে শিবচর পৌর বাজারের একটি সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাকিব।
এ সময় ৪ থেকে ৫ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাকিবের মৃত্যু হয়।
কেরানীগঞ্জে দিনেদুপুরে যুবককে কুপিয়ে হত্যা : কেরানীগঞ্জে দিনদুপুরে ছগির নামে এক যুবককে সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবার বলছে, স্ত্রীর পরকীয়ার জেরেই এ খুন ঘটেছে। স্থানীয়রা জানান, সকালে দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন ছগীর। নাজিরেরবাগ সড়কে পৌঁছাতেই দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্রের কোপে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তখন হামলাকারীরা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
কক্সবাজারে আরো ভয়াবহ এক ঘটনায় স্বামীকে হত্যা করার পর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক ব্যক্তিকে আটক করেছে। জানা যায়, পুলিশের হাতে আটক বিরেল চাকমা কয়েকদিন থেকে ওই নারীকে কুপ্রস্তাব দিচ্ছিলেন। রাজি না হওয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হন। গত শনিবার রাতে মদ্যপানের সময় ওই নারীর স্বামী রঞ্জন চাকমা ও বিরেল চাকমার মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে বিরেল চাকমা ধারালো দা দিয়ে রঞ্জন চাকমার মাথায় সজোরে কোপ দিয়ে হত্যা করেন। পরে তিনি ওই নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।
নেত্রকোনায় বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যুবককে হত্যা : নেত্রকোনায় পূর্ব বিরোধের জেরে ১৯ বছরের তরুণ জাহাঙ্গীরকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলমের বড় ভাই মো. আলমগীরের মুদি দোকান রয়েছে। একই এলাকার রনি মিয়া (২০), অরঙ্গরাজ এলাকার তরিকুল ইসলাম (২১) আলমগীরের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার টাকা ধার নেন। পাওনা টাকা চাইলে ওই দুই তরুণ দেই-দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করেন।
গত কয়েক দিন আগে শহরের কুড়পাড় এলাকায় রনি নামের এক যুবক ওই দুই যুবককে পাওনা টাকা পরিশোধ করতে সময় বেঁধে দেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আলমগীর ও তার ভাই জাহাঙ্গীর ওই দুই যুবককে একত্রে পেয়ে তাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করেন। পরে ওই দুই যুবক মধ্যস্থতাকারী রনির কাছে নালিশ করেন। এ ঘটনায় রনি ক্ষিপ্ত হয়ে গতকাল শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে লোকজন নিয়ে জাহাঙ্গীরের বাড়ির সামনে হাজির হন। পরে জাহাঙ্গীরকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে তাকে হকিস্টিক, রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর অচেতন হয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। পরে ওই হাসপাতালে রাত ১১টার দিকে জাহাঙ্গীর মারা যান।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হত্যাকাণ্ডগুলোর প্যাটার্ন লক্ষ করলে দেখা যায়, পারিবারিক বা সামাজিক বিরোধ, নয়তো আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটছে। কিন্তু যেটা ভয়াবহ তা হলো- খোলামেলাভাবে, প্রকাশ্যে, মানুষের চোখের সামনে খুন হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে অপরাধীরা আইনের প্রতি ভয় হারিয়ে ফেলেছে। তারা আরো বলেন, অপরাধের পরপরই যদি আসামিদের গ্রেফতার না করা যায়, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত না হয়, তাহলে খুনিদের সাহস আরো বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখানে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, খুনের বাড়বাড়ন্তের পেছনে সামাজিক অস্থিরতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বড় দায় রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হবে, অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে, ততদিন এ ধারা চলতেই থাকবে।
প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ ‘প্রাথমিক তদন্ত চলছে’ বা ‘আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে’- এমন বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ঘটনায় খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। মাদারীপুরের শিবচরে প্রকাশ্যে শত মানুষের সামনে খুন হলেও এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
অপরাধ দমনে ব্যর্থতার প্রসঙ্গে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো বলছে, এটা শুধুই পুলিশের ব্যর্থতা নয়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতাও স্পষ্ট। একের পর এক খুন হচ্ছে, কিন্তু দ্রুতবিচার হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি আর খুনিদের মধ্যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুনের ঘটনা কমাতে হলে প্রথমত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে স্থানীয় প্রশাসনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। তৃতীয়ত, এলাকায় এলাকায় পুলিশের নিয়মিত টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা কমানো ছাড়া হত্যাকাণ্ড কমবে না। বিচারহীনতা যতদিন থাকবে, ততদিন দেশে খুনের ঘটনা বেড়েই চলবে।
কেকে/এআর