সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী করতে নতুন খসড়া বিধিমালা প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ)। খসড়া বিধিমালায় সরকারি ক্রয়ে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ইজিপি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। পাশাপাশি অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, নারী-মালিকানাধীন ও নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ ক্রয়ে বিদ্যমান ১০ শতাংশ মূল্যসীমা বিলোপ এবং ডিবারমেন্টের (নিষেধাজ্ঞা) ক্ষেত্রে আপিলের সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিপিপিএ জানায়, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে আইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, ক্রয় প্রক্রিয়ার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসামঞ্জস্য দূর করা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা বেস্ট প্র্যাকটিসের সাথে মিল রেখে সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা আধুনিক করার দিকগুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
নতুন খসড়ায় ৯৪টি সংশোধনের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ১২টি নতুন বিধি। বাতিল হয়েছে ৭টি বিধি। সংযোজন হয়েছে ৪টি নতুন তফসিল, সংশোধন হয়েছে আরও ৮টি। পাশাপাশি ১৮টি উপধারা বাতিল করে মোট ১৫৩টি বিধি নিয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন কাঠামো।
খসড়া বিধিমালায় উল্লেখযোগ্য সংস্কারের মধ্যে রয়েছে সব সরকারি ক্রয়ে ই-জিপি বাধ্যতামূলক করা। অনলাইনের বাইরে দরপত্র আহ্বান বা চুক্তি করার সুযোগ থাকবে না, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বিপিপিএর অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া, আগে প্রাক্কলিত মূল্যের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পার্থক্যের সীমা ছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। অতিরিক্ত কাজ বা সরবরাহের জন্য নতুন ধারা তৈরি করা হয়েছে এবং ভেরিয়েশনের সীমা কমিয়ে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুনভাবে ভৌত সেবা বা শ্রমঘন সেবাকে আলাদা ক্যাটাগরি হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির পরিসর বিস্তৃত করা হয়েছে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে বিপরীত নিলাম প্রক্রিয়া চালুর বিধান রাখা হয়েছে। নারী-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা সংযোজনও অন্যতম পরিবর্তন। চুক্তি ব্যবস্থাপনায় যোগ হয়েছে কঠোরতা। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিকানা বা উপকারভোগী মালিকের নাম প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকারি সম্পদ বিক্রি বা নিষ্পত্তির নতুন নিয়ম আনা হয়েছে। পাশাপাশি, চুক্তি বাতিলের আগে স্বতন্ত্র কমিটির সুপারিশ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নতুন ক্রয় নীতিতে দরকষাকষির সুযোগও বাড়ানো হয়েছে। ভৌত সেবা, আন্তর্জাতিক ক্রয়, বিভাজনযোগ্য পণ্য কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জরুরি ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরকষাকষির বিধান রাখা হয়েছে। শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের ক্ষেত্রে কালো তালিকাভুক্তকরণ ও সাময়িক স্থগিতাদেশের বিধান আরও কঠোর করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ডিবারমেন্ট রিভিউ বোর্ড গঠনের প্রস্তাব এসেছে।
বিপিপিএ বলছে, পুরো খসড়ায় ৯৪টি বিধি সংশোধন করা হয়েছে। নতুন করে ১২টি বিধান যুক্ত হয়েছে, বাতিল হয়েছে ৭টি বিধি এবং বাদ গেছে ১৮টি উপবিধি। এ ছাড়া ৪টি নতুন তফসিল সংযোজন এবং ৮টি সংশোধনের প্রস্তাব রয়েছে। ফলে সরকারি ক্রয় কাঠামো আরও বিস্তৃত ও সময়োপযোগী হয়ে উঠবে।
বিপিপিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সচিব) এসএম মঙ্গন উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের মোট উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় হয় প্রকিউরমেন্ট খাতে। এ কারণে এখানে এক ধরনের ‘মাফিয়া চক্র’ তৈরি হচ্ছে। কিছু অসাধু গোষ্ঠী প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমকে নিজেদের স্বার্থে ম্যানুপুলেট করছে। কাজ যেনতেনভাবে আদায় করে নিয়ে সমাজে এক ধরনের অলিগার্ক শ্রেণি গড়ে উঠছে।
তিনি বলেন, সিন্ডিকেট গড়ে কাজ বাগিয়ে নেওয়া, পরে আবার সেই কাজ বিক্রি করে দেওয়াই অনেক ঠিকাদারের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই টেন্ডার মাফিয়া ও সিন্ডিকেট চক্র প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিপিপিএ’র পরিচালক শাহ ইয়ামিন-উল ইসলাম বলেন, ২০২৫ খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে ২০০৬ সালের সরকারি ক্রয় আইন সংশোধনের ধারাবাহিকতায়। ওই সংশোধনটি সরকারি ক্রয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর মাধ্যমে আনা হয়, যা চলতি বছরের ৪ মে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বিদ্যমান সরকারি ক্রয় বিধিমালা, ২০০৮-কে সংশোধিত সরকারি ক্রয় আইন, ২০০৬-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিভিন্ন পরামর্শ সভায় অংশীজনদের পক্ষ থেকে বিধিতে অনেক বেশি পরিবর্তনের প্রস্তাব আসায় ২০০৮ সালের বিধিমালা সংশোধনের বদলে একটি নতুন বিধিমালা প্রণয়ন অধিকতর কার্যকর মনে করছে। সে কারণেই বিপিপিএ প্রস্তাবিত সরকারি ক্রয় বিধিমালা, ২০২৫-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, এই খসড়া বিধিমালার লক্ষ্য হচ্ছে সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ ক্রয়ের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারের আশা, এ উদ্যোগ সরকারি অর্থব্যবস্থায় সুশাসন ও দক্ষতা বাড়াবে।
কেকে/ এমএস