অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। শুরুতে দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বড় বড় ঘোষণা দিলেও বাস্তবে দেশ এখনো আমলাতন্ত্রের জটিল ফাঁদে আটকে আছে। সংস্কারের গতি শ্লথ, আর দুর্নীতি দমনে নেই প্রত্যাশিত অগ্রগতি। সব মিলিয়ে, এক বছরের পথচলায় স্পষ্ট হচ্ছে সংস্কারের ইচ্ছা থাকলেও আমলাতন্ত্রের ফাঁদ ভাঙতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন এখনো নাগরিকদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এসব কমিশন নির্বাচন, পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার, দুর্নীতি প্রতিরোধ, প্রশাসন আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। তবে সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, গত কয়েক দশকে বিভিন্ন কারণে আমলাতন্ত্রের প্রভাব ক্রমশ বেড়েছে। এর একটি বড় কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। সরকার পরিবর্তনের পরও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে খুব একটা পরিবর্তন না আসার ফলে তারাই হয়ে ওঠেন ক্ষমতার মূল স্তম্ভ। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর এবং মাঠপর্যায়ে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমলাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে দেশের দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক প্রথা রাষ্ট্র সংস্কারের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও এটি কোনো নতুন সমস্যা নয়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা বেড়েছে। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিরাই হবেন প্রধান চালিকাশক্তি। কিন্তু আমলাতন্ত্রের অতি-ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি বলে মনে করছেন তারা। তারা আরো বলছেন, আমলাদের কাজ হওয়া উচিত সরকারকে সহায়তা করা, নীতিনির্ধারণ করা নয়। এ সমস্যার সমাধানে প্রশাসনিক সংস্কার আনা জরুরি, যেখানে আমলারা জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন, শাসক হিসেবে নয়। একইসঙ্গে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, গত এক বছরে সীমিত পরিসরে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা মূলত ব্যাংক ও পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক। প্রশাসন, ভূমি, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত খাতে তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনকেও এখনো স্বাধীনভাবে কার্যকর করা যায়নি।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আগে জানতাম না আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচ কাকে বলে। কর্মসংস্থান খাতায় আছে, কিন্তু রাস্তায় নেই। কর্মসংস্থানের জন্য একটি মন্ত্রণালয়ের একটি উইং তৈরির প্রস্তাব আমি পাঠিয়েছি। প্রস্তাবটি কেবিনেট ডিভিশনে পাঠানো হয়, সেখান থেকে আবার অন্যখানে পাঠানো হয়েছে সেই দপ্তরের নামও আমি বলতে পারি না। সেখানে বসে দীর্ঘ যাচাই-বাছাই হবে। এর মানে, দুই-তিন বছরেও এটি আলোর মুখ দেখবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানের আজ ট্রেনিং দেওয়ার কথা, তারা সাপোর্ট কোথায় পাবে? আমি একটি চিঠি দিয়ে লোক পাঠাই, বলি অফিস প্রধানের সামনে বসে থাক। রিপ্লাই না পাওয়া পর্যন্ত ফিরে এসো না। তাহলে আমি কী করব?’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের যেসব উপদেষ্টা দায়িত্ব পালন করছেন তারা এখনো অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়, সবকিছু নির্ধারণ করে আমলারাই। আমরা আশা করি উপদেষ্টারা এতদিন যে চেষ্টা করেছেন সেখান থেকে আমরা সবাই মিলে যদি শুরু করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ বৈষম্যহীন বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন যে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের কথা বলছি, সেখানে দীর্ঘদিনের অনাচার, অবিচার, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি কাটিয়ে একদিনে সুন্দর রাষ্ট্র গড়ে তুলব এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। এক বছরের মধ্যে সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন এমনটাও মনে করার কারণ নেই।’
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, আমলারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কাজ পরিচালনা করেন। আমলারা নিয়োগপ্রাপ্ত স্থায়ী কর্মকর্তা এবং তাদের পদ রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও বহাল থাকে। তারা কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে দায়িত্ব বিভাজনের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। তাদের কাজ হলো যে কোনো বিষয়ে শুধু আইনগত দিকগুলো সরকারের কাছে উপস্থাপন করা। অর্থাৎ তারা আইনের আলোকে কী কী সম্ভব আর কী কী সীমাবদ্ধতা আছে, সেটিই ব্যাখ্যা করেন।’
তিনি বলেন, ‘নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সচিব বা আমলাদের নেই। ফাইল বা প্রস্তাব তারা যাচাই-বাছাই করে আইনগত মতামত দেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা থাকে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে। কোনো প্রস্তাব পাস করা বা অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার থাকে উপদেষ্টা বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে। আবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুমোদন দিয়ে থাকেন প্রধান উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী।’
মাঈন উদ্দিন আরও ব্যাখ্যা করেন যে, অনেক সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা থাকে, যেন সচিব বা আমলারা দেশের নীতিনির্ধারণ করেন। বাস্তবে তারা নীতি প্রণয়নকারী নন; বরং আইন, বিধি ও প্রক্রিয়া মেনে সরকারের সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। এরপর সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বই সেই বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ধরা যাক কোনো নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা সেখানে আইনি কাঠামো, আর্থিক সম্ভাব্যতা, নীতি-সঙ্গতি এবং ঝুঁকিগুলো যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট আকারে মন্ত্রী বা উপদেষ্টার কাছে পেশ করেন। কিন্তু সেই প্রকল্প গ্রহণ করা হবে কি না, অর্থ বরাদ্দ আসবে কি না, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর।’
তার মতে, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পারস্পরিক সমন্বয়ই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয় বা স্বচ্ছতা না থাকে, তখন সাধারণ মানুষের কাছে ভুল ধারণা তৈরি হয় যে, সবকিছু আমলাদের হাতে চলে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আমলাতন্ত্রের কারণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কাজ আটকে আছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন নিয়োগ বা বদলি আটকে আছে। সচিবালয় এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে রদবদল সীমিত করা হয়েছে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। আমলারা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না, কারণ যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ হয় বন্ধ আছে, নয়তো অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা সব সময়ই ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের’ কথা বলি। বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক চরিত্রের নয়, সেখানে আমলাতন্ত্রের প্রভাব আরও বেশি দেখা যায়। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর কারণে আমলাতন্ত্রের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে এ নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আমলাতন্ত্রই। অন্তর্বর্তী সরকার অনেক কিছু ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিলেও আমলাতন্ত্রে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি। বাস্তবায়নের সাফল্য নির্ভর করছে আমলারা যেভাবে কাজ করবে তার ওপর।’
ড. মাহবুবুর রহমানের মতে, আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো মন্ত্রী বা উপদেষ্টা সফল হতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘আমলারা নীতি নির্ধারণের মূল চালিকাশক্তি। উপদেষ্টা একজন হলেও প্রশাসন পরিচালনা করেন স্থায়ী কর্মকর্তারাই। তাদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্য আমলাতন্ত্রকে গণমুখী করতে হবে।’
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়গুলোতে যে নেটওয়ার্ট সেখানে নাগরিকরা যে রাষ্ট্রের মূল মালিক এটা আমলাদের মাথায় নিতে হবে। তাদের কাজ হবে নাগরিকের ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করা। এজন্য কাঠামোগতভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।’
ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আমলাদের কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। কিছু হয়তো পদোন্নতি হচ্ছে, পুরোনো লোকের স্থানে নতুন লোক দায়িত্বে আসছে। আমলাকে নাগরিকবান্ধব করা আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। সরকার কর্তৃত্ববাদী আমলাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। তাদের ওপরই নির্ভরশীল।
কেকে/ এমএস