চারপাশে প্রতিবেশি আর স্বজনদের ভিড়। বিলাপ-সান্ত্বনা কোনো কিছুই ছুঁয়ে যাচ্ছে না খতিজা আকতারকে। তিনি একেবারে নির্বাক। চোখে পানি নেই। বসতঘরের সামনে মাটিতে বসে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে এদিক-ওদিক তাকান। কিছুক্ষণ পরপর মূর্চা যাচ্ছিলেন। সবাই সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টায়। কিন্তু কিছুতেই মনকে বুঝাতে পারছেন না তার একমাত্র সন্তান ‘মাহিন’ আর নেই।
শনিবার (২৩ আগস্ট) চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এমন হৃদয় বিদারক আর মর্মান্তিক দৃশ্য। আগেরদিন শুক্রবার খতিজা আকতার এবং লোকমান দম্পতির একমাত্র পিত্র সন্তান মো. রিহান উদ্দিন প্রকাশ মাহিনকে (১৫) চুরির অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আহত করা হয় সমবয়সী মানিক, রাহাত ও মাহিনের বাবাকেও।
মাহিনের বাবা মুহাম্মদ লোকমান বাড়ির পাশে একটি মুদির দোকান করেন। তিনি একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায়। মৃত্যুর শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে তাদের গ্রামের বাড়িটি। চোখ জলে ভিজে গেছে। যেন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে সবাই।
কাঁদতে কাঁদতে বাবা মুহাম্মদ লোকমান বলেন, ‘একে একে তিন ছেলে সন্তান জন্মের পর সবাই মারা যায়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আদরের মাহিন জন্ম নেয়। পরম যত্নে তাকে কোলে-পিঠে মানুষ করি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার পাশাপাশি বাবাকে সহযোগিতা করে মাহিন বাবা-মায়ের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে সব শেষ হয়ে গেছে তার। চারপাশ শুধুই অন্ধকার দেখছেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।’
উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড চেইঙ্গার ব্রিজের পাশে এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। নিহত মাহিন ওই এলাকার সাকর আলী তালুকদার বাড়ির মুহাম্মদ লোকমানের ছেলে। ঘটনার পর পুলিশ দুই যুবককে আটক করেছেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেদিন মাহিনসহ তিন কিশোর চট্টগ্রাম শহর থেকে ফেরার পথে চেইঙ্গার ব্রিজ এলাকায় অবস্থান করছিল। এ সময় এলাকার প্রতিপক্ষ একটি গ্রুপ তাদের ধাওয়া করে। প্রাণ বাঁচাতে তিনজন একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়। কিন্তু হামলাকারীরা জোরপূর্বক তাদের নিচে নামিয়ে ব্রিজের ওপর বেধড়ক মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই মাহিনের মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত মানিক ও রাহাতকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তারা বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) ভর্তি আছেন। এসময় সন্তানকে বাঁচাতে এলে মাহিনের বাবা লোকমানকেও পিটিয়ে জখম করা হয়।
মাহিনের মা খতিজা আকতারের অভিযোগ, ‘তারা তিন বন্ধু শহরের আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেদিন ভোরে ফেরার পথে সন্দেহবশত কিছু দুষ্কৃতকারী তাদের উগ্র ও নৃশংস হামলা চালায়।
মায়ের দাবী—সন্তান হত্যার বিচার কি তিনি পাবেন? তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাহিনের খুনিদের ফাঁসি না হলে আমি মা নিজেই বিষপানে আত্মহত্যা করব। এর দায় জজ (বিচারক) এড়াতে পারবেন না। আপনাদের সবাইকে বলে রাখলাম।’
নিহত মাহিনের ফুফি সুখি বেগম বলেন, ‘সেই ব্রিজের ওপর মুমূর্ষু অবস্থায় আদরের মাহিন এক গ্লাস পানি চাইলেও দুর্বৃত্তদের হুমকিতে দিতে পারিনি। এই কষ্ট আমি কীভাবে সহ্য করব। তার দাবি—এটি পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকান্ড। যেখানে এলাকার শত শত মানুষ জড়িত। আমি এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার চাই। হামলাকারীদের অবিলম্বে ফাঁসি চাই।’
নিহত মাহিনের সত্তরোর্ধ দাদী সাজু বেগম বলেন, ‘প্রতিবেশি জানে আলম, তৈয়ব, রোমন, আজাদসহ শতাধিক লোকজন জড়ো করে আদরের নাতিকে পিটিয়ে মেরেছেন। আমি আল্লার কাছে বিচার দিলাম—যাতে তাদেরও এভাবে মরণ হয়।’
খবর পেয়ে আদ্যাপান্ত জানতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুল ইসলাম সানতু, ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম ও ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আহমদ।
ইউএনও মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দ্বায়িত্বশীল আচরণের অনুরোধ জানান।’
ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর আহমদ বলেন, ‘পুলিশের উর্ধ্বতনরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ইতোমধ্যে এই মামলায় দুইজনকে আটক করা হয়েছে। আবার ঘটনার সাথে জড়িত অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। কী কারণে এ হত্যাকান্ড তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আসল রহস্য উদঘাটনে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’
কেকে/এজে